লেখা: হৃদয় বড়ুয়া। (সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষার্থী-চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ।
১৬ বছর শাসনকৃত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায়।
মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে অন্যতম মেরুদন্ড শিক্ষা এবং কারিগর শিক্ষকরা। জ্ঞান সৃষ্টির সাম্রাজ্য বা মেরুদণ্ডে এতো আঘাত করেছে বিগত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচালকরা। এই ক্ষত সারাতে অধিক সময়ের প্রয়োজন। অন্যদিকে একটি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারাটাও শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক কারিকুলাম, অযোগ্য পরিচালক ও প্রতিহিংসাময় রাজনীতি দায়ী। বিগত সরকারের শিক্ষা খাতে ২০২১-২২ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ২.০৮ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১.৮৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১.৭৬ শতাংশ। যেখানে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা। সেখানে বিগত সরকার গুলোর প্রতি বাজেট শিক্ষাখাতকে অমূল্যায়িত করেছে। অন্যান্য দেশে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ সর্বপ্রথম মূল্যায়িত ও নিশ্চিত করণ করে। শিক্ষায় বরাদ্দ কোনো খরচ নয়, বরং বিশাল বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে। যেসব দেশ এটি বুঝতে পেরেছে, সেসব দেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর, দক্ষতা, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক সমাজ গড়ে তুলতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করতে হবে। এ জন্য দরকার শিক্ষা বা গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, যার সুফল পাবে দেশ ও জনগণ। তাহলে সেদিক দিয়ে বিগত সরকার গুলো বিশাল একটি মেরুদণ্ডহীনতা করেছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে বড় প্রভাব যে শিক্ষার উপর পড়বে তা নিশ্চয়ই আমাদের অজানা ছিল। শিক্ষার প্রতি পদে পদে এমন দুর্নীতি অনিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহার করা অযোগ্যরাই বেশিরভাগ আশ্রয়িত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের দিকে যদি লক্ষ্য করি সুস্পষ্ট যে কিছু সুবিধার্থে সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের ইচ্ছামতে নিজ-নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগদান করছেন এবং অপছন্দের ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। আবার অনিয়ম দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ যারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তাদেরও পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করছে ছাত্ররা। সরকার পতনের পর প্রায় শতাধিকেরও অধিক স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বরত শিক্ষকরায় ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে পড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দাবিকৃত পদত্যাগকারী শিক্ষকগণ অনিয়ম দুর্নীতিতে কতটুকু জড়িত তার অধিকাংশই সঠিক তথ্য নেই বললে চলে। দক্ষ,অভিজ্ঞ, যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষকহীন প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু শিক্ষাব্যবস্থায় টেকসই হবে তা অজানা।
আমরা অনিয়ম, দুর্নীতি দেখলে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে পারি এবং পদত্যাগের জন্য দাবিও করতে পারি। কিন্তু সঠিক প্রমানের প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে তেমন কিছু শৃঙ্খলা বা পদ্ধতি মানাটাও আবশ্যক। “আমাদের ওই শিক্ষককে ভালো লাগছে না, রাজনৈতিক স্বার্থে বা নিজস্বার্থে আমরা বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন করলাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ঘেরাও করলাম, সচিবালয় ঘেরাও করে এক দফা এক দাবি বলে জোরপূর্বক পদত্যাগ করালাম”। এভাবে তো একটি শিক্ষাব্যবস্থা চলে না!
আমাদের যৌক্তিক দাবী ও সঠিক প্রমাণ গুলো তুলে ধরতে হবে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের যিনি শিক্ষা উপদেষ্টায় দায়িত্বরত রয়েছেন বা স্থানীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর তথ্য প্রমাণ ডকুমেন্টস আকারে প্রদান করে একটি যৌক্তিক নির্ধারিত সময় বেঁধে দিয়ে দাবী গুলো জানানো প্রয়োজন। তারপর মন্ত্রণালয় তদন্ত অনুসারে তার একটি ব্যবস্থা গ্রহন করবে। যদি মনে হয় মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্তটি দিয়েছে সেটি যৌক্তিক নয় তাহলে সেই যৌক্তিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও স্থানীয় সমন্বয়কদের সহযোগিতায় অবশ্যই আন্দোলন করতে পারি।
শিক্ষার এমন পরিস্থিতিতে দায়ী কে বা কারা?
বিগত সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে; যিনি শিক্ষা পরিচালনায় আসেন তার একটি রাজনৈতিক শাসনরীতি বা অনুসরণরীতি চালু করেন। যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করলো যা ইচ্ছা তাই বল প্রয়োগ করলো শিক্ষকদের ব্যবহার করে। কারণ আমাদের মানুষ গড়ার কারিগরদের প্রতি আলাদাভাবে একটি দুর্বলতা কাজ করে। আর সেই দুর্বলতার সুযোগ প্রতিহিংসাময় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিজস্ব তৈরি আইনে শাসন করে ছাত্রদের।
মেরুদণ্ড গড়ার কারিগররা এসময়ে অপমানিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও লাঞ্ছিত কেন?
ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে শিক্ষকগণ। পুলিশের অমানবিকভাবে অত্যাচার, গুম-খুন ও নিমর্মভাবে গুলি করেছে ছাত্রদের উপর, তখন সর্বপ্রথম অভিভাবকের ছাঁয়া হয়ে শিক্ষকরা দাঁড়িয়েছে। মনোবল দিয়েছে, রাজপথে নেমেছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে থানায় গিয়ে ছাত্রদের মুক্ত করেছে যা আমরা দেখেছি।
ছাত্র-শিক্ষকদের আজকে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এমন দূরত্বে শিক্ষকগণ দায়ী নয়?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি জ্ঞান অর্জনের স্থান। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা শুধুমাত্র শিক্ষক ধারা নয়, ছাত্র-শিক্ষক উভয় মিলে জ্ঞান সৃষ্টি করবে। অতএব এটি শেখার জায়গা, গবেষণার জায়গা যা মানবজাতির একটি মেরুদন্ড অধ্যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা রাজনীতি যেভাবে বেড়ে চলেছে যদি শিক্ষকদের লক্ষ্য করি; শিক্ষা গবেষণার চেয়েও রাজনীতিকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। যেমন একটি শিক্ষকের পদোন্নীতির জন্য, বেতন বৃদ্ধির জন্য, স্থায়ীকরণের জন্যসহ বিভিন্ন যেই রাজনৈতিক খাদ্য জালটি রয়েছে সেটি আদায়ের লক্ষ্যে হলেও বা ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করার জন্য হলেও আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে দল বলুন সে দলকে অনুসরণ করে নিরুপায় হয়ে অনেকের এমন পদ অবলম্বন করতে হয়। তাহলে এক পর্যায়ে শিক্ষকরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক একত্রে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক মনোভাব। বর্তমান রাজনীতিটা হচ্ছে প্রতিহিংসাময় কিন্তু প্রতিযোগিতাময় নয়। আবার এই রাজনীতিটি দলের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ভিত্তিক অনুসরণ করে হয়ে থাকে, তাহলে এইদিকেও ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের অমিল সৃষ্টি দেখা যাচ্ছে। বন্ধুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জনময় সম্পর্ক নেই বলে ছাত্র- শিক্ষকের এতই দূরত্ব আজ একে অপরের বিপরীত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষার এমন ডুবন্ত সময়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত করে নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব নিয়মকানুন ও কতৃপক্ষের নির্দেশে থাকতে হবে, এগুলোতে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে যেন না পারে সেদিকেও নজরদারি রাখতে হবে। এতে প্রতিহিংসাময় রাজনীতি, পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির রাজনীতি বন্ধ হবে এবং ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.