=====
উজব শব্দের অর্থ আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমা। আজব অর্থ অবাক হওয়া, আশ্চর্যান্বিত হওয়া বা তাজ্জব হওয়া। নিজের কর্মে বা মতে নিজেই অবাক হওয়া, পরিতৃপ্ত থাকা বা আত্মগরিমায় ভোগাকে উজব বলা হয়।
উজব, আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমা অহঙ্কারের একটি দিক। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, নিজেকে অন্য কোনো মানুষ থেকে কোনো দিক থেকে উন্নত, ভালো, উত্তম বা বড় মনে করা, অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের চেয়ে হেয় মনে করাই কিবর, তাকাব্বুর বা অহঙ্কার। এটি মূলত একটি মানসিক অনুভূতি, তবে কর্মের মধ্যে অনেক সময় তার কিছু প্রভাব থাকে।
মহান আল্লাহ বলেন:”নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।”[ সুরা(৪) নিসা:৩৬ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,” তুমি মানুষের জন্য তোমার ঘাড় বক্র কর না এবং তুমি পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না; আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”[সুরা(৩১) লুকমান:১৮ আয়াত]
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার বিদ্যমান সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” তখন এক ব্যক্তি বলেন,”মানুষ তো ভালবাসে যে তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক……..।” তিনি বলেন: আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য ভালবাসেন। অহঙ্কার হচ্ছে সত্য অপছন্দ করা ও মানুষদেরকে অবজ্ঞা বা হেয় করা।”[মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯৩ (কিতাবুল ঈমান,বাবু তাহরীমিল কিবরি ওয়া বায়ানিহী)]
অহঙ্কার মহান আল্লাহর অধিকার। কোনো মানুষের জন্য অহঙ্কার করা মূলত আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ। কারণ, অহঙ্কারের বিষয় সর্বদা আল্লাহর নিয়ামতেই হয়। পৃথিবীর সকল নিয়ামত আল্লাহ সবাইকে সমানভাবে প্রদান করে না। কাউকে দেন, কাউকে দেন না অথবা কমবেশি প্রদান করেন। যিনি নিয়ামত পেয়েছেন তার দায়িত্ব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু যদি তিনি এ নিয়ামতকে আল্লাহর দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসাবে গ্রহণ না করে নিজস্ব উপার্জন ও সম্পদ মনে করেন তখনই অহঙ্কারের শুরু হয়। এতে প্রথমেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বেশি নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দার দায়িত্ব কম নিয়ামত প্রাপ্ত কোনো বান্দাকে দেখলে প্রথমত আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং দ্বিতীয়ত কম নিয়ামত প্রাপ্ত ব্যক্তির সাথে যথাযোগ্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধাভরে আচরণ করা।
অহঙ্কার ধ্বংসের পথ। সবচেয়ে নোংরা অহঙ্কার “ধার্মিকতার অহঙ্কার” বা ‘উজব’। ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির কারণে বা কোনো বিশেষ ধর্মীয় দলের অনুসারী হওয়ার কারণে নিজেকে অন্য কারো চেয়ে বেশি ধার্মিক বলে মনে করা বা নিজের ধার্মিকতায় সন্তুষ্টি বোধ করাই “উজব”। বস্তুত এর চেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই নেই। এর বড় কারণ নিজের পাপ ও দূর্বলতার দিকে না লক্ষ্য করে অন্য মানুষের পাপ-অন্যায়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের মুকাবিলায় আসলেই কিছু গ্রহণযোগ্য নেক আমল করতে পেরেছি কিনা তার ঠিক নেই, যা কিছু করেছি তা আল্লাহর নিকট কবুল হয়েছে কিনা তারও ঠিক নেই, মৃত্যু পর্যন্ত এ আমল ধরে রাখতে পারব কিনা তারও ঠিক নেই, এরপরও মুমিন কিভাবে নিজেকে অন্যের চেয়ে অধিক ধার্মিক বলে চিন্তা করতে পারেন ? ধ্বংসের জন্য এর চেয়ে বড় পথ আর কিছুই হতে পারে না।
এজন্য হাদিস শরীফে ” উজব”-কে পাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমরা যদি পাপ না করতে তাহলে আমি তোমাদের জন্য পাপের চেয়ে ভয়ঙ্করতর বিষয়ের ভয় পেতাম, তা হলো উজব, তা হলো উজব।”
[আলবানী, সহিহুল জামি ২/৯৩৮ (নং ৫৩০৩) হাদিসটি হাসান]
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ধ্বংসকারী স্বভাবগুলি হলো (১) আনুগত্যকৃত লোভ-কৃপণতা, (২) অনুসরণকৃত প্রবৃত্তি এবং (৩) নিজের বিষয়ে মানুষের পরিতৃপ্তি।” [হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯১: আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১২। হাদীসটি হাসান লিগাইরহী]
ঈমানের অহঙ্কার, ইলমের ইত্যাদি বিষয়ে উমার (রা) বলেন: “যে ব্যক্তি বলে: আমি মুমিন সে কাফির, যে ব্যক্তি বলে: আমি আলিম সে জাহিল এবং যে ব্যক্তি বলে: আমি জান্নাতী সে জাহান্নামী।” [ইবনু কাসীর, তাফসীর ২/৩৩২ (সুরা নিসার ৪৯ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে) ]
উজব বা আত্মতৃপ্তি ও আত্মগরিমার একটি প্রকাশ সকল মানুষের মধ্যে ত্রুটি দেখা এবং নিজে বা নিজের মতাবলম্বী ছাড়া সকলেই খারাপ পথে চলছে বলে দাবি করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ” যদি কেউ বলে – যদি শুন যে কেউ বলছে-: মানুষেরা ধ্বংস হয়ে গেল, তবে সে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত।”[মুসলিম আস-সহীহ ৪/২০১২৪ ( কিতাবুল বিররি…বাবুন নাহই আন কাওলি: হালাকান্নাস)]
অহঙ্কার, আত্মতৃপ্তি বা আত্মগরিমার একটি প্রকাশ ব্যক্তিগত, দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে অন্যান্য মানুষদের উপহাস করা, অবজ্ঞা করা। যদি সত্যিই কেউ বাহ্যিকভাবে উপহাস বা অবজ্ঞা যোগ্য হয় তাকেও উপহাস করা যায় না; কারণ হতে পারে আল্লাহর কাছে সে উত্তম।
আল্লাহ বলেন: “হে মুমিনগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস-বিদ্রূপ না করে; হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। কোনো নারী যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ-উপহাস না করে; হতে পারে সে বিদ্রূপকারিণী অপেক্ষা উত্তম। আর তোমরা একে অপরকে নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না। ঈমানের পর পাপী নাম পাওয়া খুবই খারাপ বিষয়। আর যারা তাওবা করে না তারাই যালিম।” [সুরা(৪৯)হুজুরাত: ১১ আয়াত]
“উজব” ইহূদী-খৃস্টানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেদের আল্লাহর ওলী, আওলাদে রাসূল বা নবীগণের আওলাদ, আল্লাহর সন্তান ও আল্লাহর খাঁটি আবিদ বলে দাবি ও প্রচার করত। এসকল বিষয়ে তারা তাদের বংশ, কাশফ, কারামত, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদির দোহাই দিত। খৃস্টানগণ এ বিষয়ে অধিক অগ্রসর ছিলেন। যে কোনো পাঠক খৃষ্টান সাধু ও পাদরিদের লেখা কাহিনী পড়লে এ জাতীয় অগণিত দাবি দেখবেন। মহান আল্লাহ তাদের এসকল দাবি-দাওয়াকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করে বলেন; “তুমি কি দেখ নি যারা নিজেদের পরিশুদ্ধতা দাবি করে। বরং আল্লাহ যাকে চান পরিশুদ্ধ করেন আর তাদেরকে সূতা পরিমাণ জুলুমও করা হবে না। দেখ, কিভাবে তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটনা করে। আর প্রকাশ্য পাপ হিসেবে এটিই যথেষ্ট। [সুরা(৪)নিসা: ৪৯-৫০আয়াত]
এ জাতীয় ‘উজব’ বা দীনাদারির আত্মগরিমা প্রকাশক সকল বিষয় কুরআন ও হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি ‘নেককার’ বা ব্যক্তিগত পবিত্রতা ও দীনদারি বোধক নাম বা উপাধি ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেন: “অতএব তোমরা নিজেদের আত্মপ্রশংসা বা পরিশুদ্ধতা-পবিত্রতা বর্ণনা করো না, কে মুত্তাকী তা তিনি অধিক জানেন।” [সুরা(৫৩) নাজম:৩২আয়াত]
যে নামের অর্থ দ্বারা ব্যক্তিকে নেককার বুঝা যায় সে নাম রাখতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপত্তি করতেন। উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা(রা)-এর কন্যা যাইনাব বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নাম রাখতে নিষেধ করেছেন। আমার নাম রাখা হয় ” বাররা” (পূণ্যবতী)। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমরা নিজেদের আত্মপ্রশংসা করো না বা নিজেদের ‘নেককার’ হওয়ার মত কোনো কথা বলো না। তোমাদের মধ্যে পূণ্যবান-পূণ্যবতী কে তা আল্লাহ অধিক অবগত আছেন। তখন তারা বলেন, আমরা তার নাম কি রাখব? তিনি বলেন :তার নাম রাখ যাইনাব।”[মুসলিম আস-সহীহ ৩/১৬৮৬ ( কিতাবুল আদাব, বাবু ইসতিহবাবি তাগয়ীরিল ইসমিল কাবীহ]
উল্লেখ্য যে, সুন্দর দেখতে একটি আরবীয় গাছের নাম “যাইনাব”। এ গাছের নামে আরবে মেয়েদের ” যাইনাব” নাম রাখার প্রচলন ছিল। এ সকল নাম ব্যক্তির সৌন্দর্য প্রকাশ করে, কিন্তু নেক আমল প্রকাশ করে না। এজন্য তিনি এরূপ নাম রাখার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি নেক আমল প্রকাশক নাম রাখতে নিষেধ করেন।
(অংশ আরো বাকী আছে)চলবে।
[ আল-ফিকহুল আকবার, ইমাম আবু হানিফা (রাহ) রচিত।
বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখা ;
ড.খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.