১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ের তিন মাস পর বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলে একজোড়া মানব-মানবীকে পাওয়া যায়। পত্রিকায় প্রকাশের পর এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হন আলমগীর কবির। অনুপ্রাণিত হন ইতালিয়ান পরিচালক লিনা ভেটমুলারের “সোয়েপ্ট অ্যাওয়ে” ১৯৭৪ থেকেও। চিত্রনাট্য সাজিয়ে ১৯৭৫ সালে শুরু করেন শুটিং।
১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় সম্পূর্ণ রঙিন ছবি সীমানা পেরিয়ে।
সীমানা – বলতে সাধারণত বোঝায় ভৌগোলিক সীমারেখা। কিন্তু ছবিতে সীমানা বলতে পরিচালক দেখিয়েছেন কিভাবে শ্রেণি-বৈষম্য ও সমাজের ভেদাভেদের সীমানা পেরিয়ে যেতে হয়।
অক্সফোর্ড পড়ুয়া আলমগীর কবির ছিলেন তুখোড় সাংবাদিক বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাত্কারও নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধেই। জহির রায়হানের “স্টপ জেনোসাইড” নির্মাণেও ছিলেন সহযোগী।
স্বভাবতই তাঁর ছবির বিষয়বস্তু সমাজ,সাম্য ও শ্রেণি বিপ্লব। “সীমানা পেরিয়েও” তাই। জমিদারের নাতনি টিনা ও জমিদারদের দ্বারা নির্যাতিত পরিবারের জেলে কালু প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে একটি দ্বীপে ছয় মাস আটকে পড়ে। উঁচুতলার মানুষের প্রতীক টিনা নিচতলার মানুষ কালুকে ভয় পায়। কালু তোতলা,
অর্থাত্ তার মতোই নিচতলার মানুষদের থেমে থেমে সংগ্রাম করতে হয়।
কালুর তোতলামো সারাতে সহযোগিতা করে টিনা এবং ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে ধনী-গরিবের সীমানা তুলে দেয়। অবরুদ্ধ দ্বীপ থেকে নাগরিক জীবনে ফিরে টিনা জানতে পারে,ঘূর্ণিঝড়ে তার মায়ের মৃত্যু হয়। তার বাবা পুনরায় বিয়ে করে টিনারই এক বান্ধবীকে। অথচ টিনা-কালুর ভালোবাসা মেনে নিতে চায় না তার বাবা। টিনা তখন বলে – বাবা – ওরাই হলো সাইলেন্ট মেজরিটি। একদিন ওরা জাগবে। দুর্যোগকে বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে ছবিতে। দুর্যোগ এবং বিপ্লব এলে সবাই এক কাতারে চলে আসে,আসতে বাধ্য হয়।
ছবির বড় একটি অংশের শুটিং হয় কক্সবাজার নিকটবর্তী একটি দ্বীপে। ভাটার সময় ইউনিট সেখানে যেত,জোয়ারে শুটিং করে আবার ভাটার সময় ফিরে আসত। পাহাড় কেটে রাস্তাও তৈরি করতে হতো। কিছু অংশের শুটিং হয় এফডিসি,বেঙ্গল স্টুডিও এবং কালিয়াকৈরের জমিদারবাড়িতে। শুটিং ও বাস্তব জীবনে ইংরেজিতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন আলমগীর কবির।
সহকারীদের নোটও দিতেন ইংরেজিতে। খুব বেশি টাকা দিতে পারবেন না জেনেও শেখার আগ্রহ থেকে অনেকেই যুক্ত হতে চাইতেন তাঁর ছবিতে। এ ছবিতে সহকারী হিসেবে মাঝপথে যুক্ত হন কাজী হায়াত্। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের পুরস্কার স্বরূপ ক্রেডিট লাইনে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নাম দেন আলমগীর কবির।
১৯৬৮ সালের “মিস ক্যালকাটা” জয়শ্রী রায় “পরবর্তী সময়ে জয়শ্রী কবির” ছবির নায়িকা। সত্যজিত্ রায়ের ছবির এই নায়িকা চমত্কার ইংরেজি বলতেন। তাঁর স্মার্টনেস,সৌন্দর্য ও ফ্যাশন সচেতনতা তখনকার নায়িকাদের মধ্যে এক ধরনের ঈর্ষাও তৈরি করেছিল। তবে শুটিংয়ে পরিচালকের প্রিয়পাত্র ছিলেন বুলবুল আহমেদ। বুলবুলের নিবেদনকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে জয়শ্রীকে আরো মনোযোগী হতে বলতেন পরিচালক।
চারটি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায় এই ছবি – শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বুলবুল আহমেদ – শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা আলমগীর কবির – শ্রেষ্ঠ সম্পাদক বশীর হোসেন ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক এম এ মোবিন। বাচসাস পুরস্কারে আলমগীর কবির হন শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার,বিশেষ পুরস্কার পান ভূপেন হাজারিকা। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বিচারে সেরা ১০ বাংলাদেশি ছবির একটি – সীমানা পেরিয়ে।
তখনকার চার লাখ টাকায় নির্মিত হয় ছবিটি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য,নান্দনিক এ ছবিটি প্রত্যাশিত মুনাফা করতে পারেনি – জানিয়েছেন প্রদর্শক মিয়া আলাউদ্দিন। জানা যায়,আশানুরূপ ব্যবসা না করায় পরিবেশক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে নির্মাণব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই প্রশ্ন আলমগীর কবিরকে ভীষণ কষ্ট দেয়।
ছবির গানে ও সুরে ভূপেন হাজারিকা অনন্য। তাঁর কণ্ঠে “মেঘ থমথম করে” ও আবিদা সুলতানার কণ্ঠে “বিমূর্ত এই রাত্রি আমার” এখনো দারুণ জনপ্রিয়।
কাহিনি,সংলাপ,চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনা – আলমগীর কবির ——-
চিত্রগ্রহণ – এম এ মবিন —–
সংগীত পরিচালনা – ভূপেন হাজারিকা ——
অভিনয় – বুলবুল আহমেদ,জয়শ্রী কবির,কাফি খান,
মায়া হাজারিকা,গোলাম মোস্তফা ও তনুজা ——
সম্পাদনা – বশীর হোসেন ——-
সার্বিক তত্ত্বাবধানে – কাজী হায়াত্ ——
মুক্তি – ১৯৭৭ ——-
পরিবেশনা – আলমগীর পিকচার্স ——-
#সংগৃহীত
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.