হাকিকুল ইসলাম খোকন, বাপসনিউজঃ
নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন যে তিনি নথিপত্রহীন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করবেন। ২০ জানুয়ারি ২০২৫,শপথ নেওয়ার আগেই তিনি সেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এ কারণে বিজয়ী হওয়ার পর নথিপত্রহীন অভিবাসীদের মধ্যে শুরু হয়েছে আতঙ্ক। তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে আমেরিকার মায়া ছাড়ছেন। ফিরে যাচ্ছেন নিজ দেশে। এসব অভিবাসীর তালিকায় রয়েছে বিপুল বাংলাদেশিও। অনেকেই বৈধতা পেতে ছুটছেন আইনজীবীর কাছে।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরে গেছেন নিউইয়র্ক প্রবাসী শরীফুল ইসলাম। স্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া একমাত্র ছেলে সন্তানকে রেখে গেছেন। তার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম বাপসনিউজকে জানান, প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে ৮ বছর আগে তার ভাই আমেরিকায় এসেছিলেন। কিন্তু ‘করছি-করবো’ বলে এদেশে বৈধতা পেতে চেষ্টা করেননি। অগত্যা গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছিলেন তিনি। পরে পরিবারের সিদ্ধান্তে আপাতত দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রফিকুল ইসলাম বলেন, স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ায় হয়তো ভবিষ্যতে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে। তাছাড়া আমার ছোট ভাই একদিনও ডিটেনশন সেন্টারে থাকতে চান না। তিনি বলেন, ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় আমাদের পুরো পরিবারে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে দেড কোটিরও বেশি নথিপত্রহীন অভিবাসী আছে। তারমধ্যে কতজন বাংলাদেশি আছে সেসবের পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। তবে এই সংখ্যা এক লাখের কম নয়, যাদের অধিকাংশের বসবাস নিউইয়র্ক সিটিতে।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সোসাইটির বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী জানান, বাংলাদেশ সোসাইটির কাছে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান নেই। দেশ থেকে আসা অনেক অভিবাসীকে বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে ইমিগ্রেশন সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঘোষণায় যারা নথিপত্রহীন, তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে জানান রুহুল আমিন সিদ্দিকী।
ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন ক্র্যাকডাউনের ঘোষণায় আতঙ্কিত না হয়ে অভিজ্ঞ অ্যাটর্নির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন ইমিগ্রেশন ও অ্যাক্সিডেন্ট কেস বিশেষজ্ঞ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বাপসনিউজকে বলেন, ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পরই বেশকিছু নির্বাহী আদেশ জারি করবেন। তার প্রথম প্রায়োরিটি হতে পারে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের বিতাড়ন। আবার তাদের মধ্যে প্রথমেই বিতাড়ন করা হবে যাদের নামে ক্রিমিনাল কেস আছে, যারা সাজাপ্রাপ্ত এবং বিতাড়নের আদেশপ্রাপ্ত। এরপর বিতাড়ন করা হবে যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, অর্থাৎ যারা এদেশে আসার পর বৈধ হওয়ার কোনো চেষ্টাই করেননি।
অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, আতঙ্কিত না হয়ে অভিবাসীদের উচিত হবে অভিজ্ঞ অ্যাটর্নির সঙ্গে পরামর্শ করা। সামনাসামনি কথা বলা।
নিউইয়র্কে নথিপত্রহীন যত অভিবাসী আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকো ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশের নাগরিক। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মেস করে তারা বসবাস করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তাদের একজন গ্যাব্রিয়েলা। তিনি বলিভিয়ার চোরাচালানীদের গাড়িতে করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। তিনি এখন ক্লিনারের কাজ করেন। গ্যাব্রিয়েল তার ভয়ের কথা জানিয়ে বলেন, এখানে আমরা যারা আছি তাদের বেশিরভাগেরই কাগজপত্র নেই। ট্রাম্প কী করবেন তাতো পরিষ্কার করে বলেছেন। আমার মনে হয় তারা কর্মস্থল থেকেও লোকজনকে ধরে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এনবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাস করা নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো দামই খুব বেশি চড়া নয়। তিনি ক্ষমতায় বসেই গণহারে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
এনবিসি নিউজকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ অনুমতি নেই, এমন লোকদের গণপ্রত্যার্পণ ছাড়া তার সামনে কোনো বিকল্প নেই। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, অভিবাসীদের প্রত্যার্পণে কত খরচ হবে, তা বড় প্রশ্ন নয়। আসলেই আমাদের কোনো বিকল্প নেই। নথিপত্রহীন অভিবাসীরা মানুষ খুন করেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা দেশকে ধ্বংস করেছে। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারবে না, তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।
এদিকে বিবিসি বলছে, নতুন প্রশাসন গণপ্রত্যার্পণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে সক্ষম হলেও এজন্য কর্তৃপক্ষকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মিলিয়ন মানুষকে বিতাড়িত করতে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
শুধু নথিপত্রহীন অভিবাসীরাই নয়, অনেক আমেরিকানও ট্রাম্পের জয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তারা অন্য কোনো দেশে চলে যেতে চাচ্ছেন। ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর থেকে কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার দেশগুলোতে পাড়ি দেওয়ার বিষয়ে গুগল সার্চে লোকজনের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে।
গুগল সার্চে দেখা গেছে, প্রায় ১২৭০ শতাংশ মানুষ কানাডা যাওয়ার তথ্য অনুসন্ধান করেছে। এ ছাড়া নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুগল সার্চ করেছে ২০০০ শতাংশ মানুষ এবং অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৮২০ শতাংশ মানুষ গুগল অনুসন্ধান করে। গুগলের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত এই তিন দেশে যাওয়ার জন্য অনেকেই গুগলে অনুসন্ধান করেছে। তবে গুগল অনুসন্ধানে প্রকৃত তথ্য পাওয়া না গেলেও নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, প্রায় ২৫ হাজার আমেরিকান ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তাদের সাইট ভিজিট করেছে। যেখানে গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০০ জন।
এদিকে অবৈধ অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয়ে কানাডায় প্রবেশ করতে পারেÑ এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। ফলে অভিবাসীদের ঢল ঠেকাতে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে কানাডা পুলিশ। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের সার্জেন্ট চার্লেস পোয়োরিয়ার জানিয়েছেন, ট্রাম্প জিতলে কানাডায় অভিবাসীদের ঢল নামতে পারেÑ এমন আশঙ্কায় কয়েক মাস আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। ট্রাম্প যেহেতু নির্বাচিত হয়েছেন, তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার অভিবাসীকে কানাডায় ঢুকতে দেখা যেতে পারে।
২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথমবার যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তার কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডায় প্রবেশ করেছিলেন। এবারও তেমনটিই দেখা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কানাডার বর্তমান অবস্থায় সরকারের একের পর এক অভিবাসন নীতির পরিবর্তনের মধ্যে নতুন চাপ তৈরি করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নতিপত্রহীন অভিবাসীরা। এটি দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
নিউইয়র্ক সিটি নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্রেট মেয়র এরিক অ্যাডামস ইতিমধ্যে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের বিদায় করার জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে তার প্রশাসনকে সবধরনের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সাথে নিউইয়র্কের বিভিন্ন হোটেলে রেখে প্রতি মাসে সিটির পক্ষ থেকে পাইলট প্রোগ্রামের আওতায় ক্যাশ ভাউচার দেয়া হয়, সেটাও বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জন্ম হলেই যে আমেরিকান নাগরিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে তাও বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পিতা মাতার যে কোনো একজনকে বৈধ বাসিন্দা হতে হবে ।
ট্রাম্পের রানিংমেট জে ডি ভ্যান্সের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ১০ লাখ নথিপত্রহীন অভিবাসীকে বের করে দেওয়া হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে বিদেশি কূটনীতিক ডেকে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে বলতে পারেন। এ কাজে তিনি রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন অঙ্গরাজ্যগুলোর নেতাদেরও সহযোগিতা নিতে পারেন। এমনকি যেসব অঙ্গরাজ্যে আইনি বিধিনিষেধ আছে, সেখানকার তহবিল বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপও নিতে পারেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কংগ্রেস এবং সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে ।
দুই বছর আগে ইকুয়েডর থেকে আসা ৪০ বছর বয়সী ইমিগ্র্যান্ট অ্যাডউইন টিটো বলেছেন, ‘আমাদের অনেকে বিচলিত বোধ করছে, বিশেষ করে যাদের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের বৈধতা প্রমাণ করার মতো কোনো কাগজপত্র এখনো নেই। তারা যদিও বৈধ কাগজপত্রে কাজ করছে, তা সত্বেও নিয়োগদাতাদের প্রতি কাগজপত্রহীন কাউকে কাজে নিয়োগ না করার ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশ তারা অমান্য করতে পারবে না এবং অনেককে কর্মস্থল থেকে আটক করা হতে পারে বলেও ইমিগ্রান্টদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন যে বর্তমান প্রেসিডেন্টের মেয়াদে তিনি মিডটাউন একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করেছেন এবং অনেক সময় কাজ থেকে বিরতি নিয়ে পুনরায় যোগ দিয়েছে। তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ট্রাম্পের অধীনে এই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যাবে বলে তিনি ভীত হয়ে পড়েছেন। তবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাম্পের ঘোষণা সীমান্তপথে ইমিগ্র্যান্ট প্রবেশে একটি বাধা সৃষ্টি করবে। সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামসের জন্য এটি একটি সুখবর যে, তিনি গত দুই বছর যাবত ইমিগ্র্যান্টদের পেছনে যে ব্যয় করেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি স্বস্তি লাভ করবেন। অর্থনীতিতে অভিবাসীদের ভূমিকা থাকলেও ৫৫ শতাংশ নাগরিক চাইছেন অভিবাসন হ্রাস পাক। অভিবাসনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে বিশেষত মেক্সিকো সীমান্তে অবৈধ প্রবেশ রুখতে রাজনৈতিক ঐকমত্যও রয়েছে বলে সম্প্রতি এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।