রাজধানীর তেজকুনীপাড়ায় অবস্থিত গরিবের বাজার। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ৪০ বছর আগে বাজারটির যাত্রা। স্থানীয়দের কাছে বাজারটি ফকিন্নি বাজার নামে পরিচিত। এখানে বিক্রি হওয়া প্রতিটি পণ্যই অন্যান্য বাজার থেকে কিছুটা কম দামের। সাধারণত নিম্নআয়ের মানুষ এই বাজারের ক্রেতা। কিন্তু গেল দুই বছর মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। এ অবস্থায় গরিবের জন্য গড়ে ওঠা নিম্ন মানের সবজি ও মাছের বাজারে ভাগ বসাচ্ছেন অনেক মধ্যবিত্ত। মুখ লুকিয়ে তারা বাজার করতে আসেন ফকিন্নির বাজারে। মান নয় দাম কমকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
সোহেল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী। স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে নিয়ে পরিবারে সদস্য পাঁচজন। খাবার, বাসাভাড়া ও সন্তানদের পড়াশোনার জন্য খাতভিত্তিক মাসের শুরুতেই হিসেব কষতে হয় তাকে। এর মধ্যে বাসাভাড়া ১০ হাজার টাকা, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ সাত হাজার, ইন্টারনেট বিল ৬০০ টাকা এবং চাল, তেল, মাছ সবজিসহ অন্যান্য খরচ আরও ১০ হাজার টাকা। কিন্তু নিত্যপণ্যের বাজারে যে হারে খরচ বেড়েছে সে হিসেবে তার আয় না বাড়ায় পরিবারের ব্যয় বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এই বেসরকারি চাকরিজীবীকে।
জানতে চাইলে সোহেল এসএমটিভি’র এই প্রতিবেদককে বলেন, যা আয় হয় তা দিয়ে আগে ভালোই চলতে পেরেছি। কিন্তু ইদানীং বাজারে ভোগ্যপণ্যের যে হারে দাম বেড়েছে তাতে আমার আয় দিয়ে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই বাজার ঘুরে কিছুটা নিম্ন মানের মাছ-সবজি কিনতে হচ্ছে। চক্ষু লজ্জার ভয়ে অনেক সময় রাতের অপেক্ষায় থাকি। কেননা সেই সময় বাজারে এলে সোসাইটির লোকজন দেখতে পাবে না।
সোহেলের মতো সীমিত আয়ের মানুষের ভোগ ব্যয় কমাতে হচ্ছে। যার জন্য মানুষ নানা পন্থায় হাঁটছেন। তেমনি একজন শিরিন আক্তার। দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার তাদের। স্বামী মিনহাজের একার আয়ের ওপর ভর করেই তাদের চলতে হয়। এর মধ্যে বড় ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ও ছোট মেয়ে পড়ছেন ক্লাস নাইনে। তবে সম্প্রতি ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি পড়াশোনার খরচ বাড়ায় এ গৃহিনী চিন্তিত।
জানতে চাইলে শিরিন আক্তার এসএমটিভিকে বলেন, স্বামী যা আয় করেন তা দিয়ে দিব্বি সংসার চালানো যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়েই কিছুটা কম দামের বাজারগুলো থেকে আমরা বেঁচে থাকার উপকরণ সংগ্রহ করছি। যাতে বাচ্চাদের পড়াশোনা ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে পারি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা বিশেস্নষণ করে দেখা যায়, গত দুই বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির হার ১০০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য সবজির ও মাছের গড় মূল্য বৃদ্ধির হার ১০৮ থেকে ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে সব থেকে বেশি বেড়েছে আলুর দাম।
তেজকুনীপাড়া রেললাইনসংলগ্ন ফকিন্নির বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়। যা অন্য বাজারে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার নিচে বিক্রি হয় না। প্রতি কেজি করলা বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, আলু ৩০, পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৭০ ও টমেটোর মতো দামি সবজিও বিক্রি হয় ৭০ টাকায়। পেঁয়াজ আলুসহ প্রায় সব সবজি ও মাছের কেজিতে ৩০ থেকে ১০০ টাকা কমে এ বাজার থেকে ভোক্তারা পণ্য ক্রয় করতে পারেন।
বাজার ব্যবসায়ীরা জানান, ৪০ বছর আগে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাজারটি গড়ে উঠেছে। কিন্তু গেল এক থেকে দেড় বছরের সময়ে এখানে নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি অনেক স্বচ্ছল ক্রেতাকেও দেখা যায়। যা এর আগে এতটা চোখে পড়েনি। এতে মানুষ যেমনি স্বাচ্ছন্দ্যে বাজার করতে পারছেন, তেমনি আমাদের ব্যবসার পরিধিও বেড়েছে।
সবজি বিক্রেতা সাথি আক্তার এসএমটিভিকে বলেন, গত ছয় বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করছি। চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের পণ্য বিক্রি করছি। আমাদের পণ্য বিক্রি ১০ টাকা থেকে শুরু হয়। কেউ চাইলে তার চাহিদা অনুযায়ী ১০ টাকার ডাল ২০ টাকার চিনি, ৩০ টাকার তেল কিনতে পারছেন।
মাছ ব্যবসায়ী হর বাবু এসএমটিভিকে বলেন, অন্যান্য বাজার থেকে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ টাকা কমে মাছ বিক্রি হয় এ বাজারে। বাজারে ২৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া রুই মাছ এ বাজারে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করি। চাপিলার ভাগা ৩০ টাকায়। অনেকে দুই তিন ভাগ এক সঙ্গে নিলে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় দিয়ে দিই। যা কেজি হিসাব করলে ৩০০ টাকা হয়। কিন্তু একই মাছ কারওয়ান বাজারে গেলে ৪০০ টাকার কমে কেনা সম্ভব হবে না।
লেখক : এসএমটিভি প্রতিবেদক, ঢাকা।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.