1. admin2@dailysmtv24.com : admin :
  2. admin@dailysmtv24.com : admin :
বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

বিদেশীদের মাথায় বাংলাদেশী চুল

সাহেদ সালাউদ্দিন ফিরোজ
  • Update Time : বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৩৬ Time View

এসএমটিভি প্রতিবেদক :

পরচুলা এখন বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে এখন পরচুলা বিদেশে রফতানি হচ্ছে। পরচুলার প্রচুর চাহিদার কারণে চট্টগ্রাম, ঢাকা, নীলফামারী, কুষ্টিয়া, কুমিল্লাসহ দেশের প্রায় সব জেলার গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠে পরচুলা তৈরির শত শত কারখানা। এই কাজে বাড়ছে কর্মসংস্থান। ফলে বাংলাদেশে গত এক দশকে উইগ বা পরচুলার বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে। গ্রামের মহিলাদের বড় একটি অংশ যুক্ত এ কাজে। উদ্যোক্তারা বলছেন, আগামী এক বছরের মধ্যে গ্রামে গ্রামে কারখানা আরও বাড়বে পাশাপাশি এই কারখানাগুলোতে অন্তত ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
পরচুলার বড়বাজার ইউরোপ-আমেরিকা। খুব বেশি না হলেও প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা আমদানিতে এই ফেলনা চুলেরও রয়েছে অংশগ্রহণ। ব্যতিক্রমধর্মী এ পণ্যের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সাড়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। যা ১০ বছরে রফতানি বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাদের মাথার চুল পড়ে যায় তারাসহ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ উইগের বড় ক্রেতা। হ্যালোইন, ক্লাউন, ক্যারিবিয়ান প্যারেড, সাম্বা ড্যান্সসহ বিভিন্ন উৎসবে যায় বাংলাদেশের তৈরি পরচুলা। বলা যেতে পারে এসব দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে চুলের ক্যাপের বাজার।
জানা যায়, আট বছর আগেও উইগ বা পরচুলা রফতানি করে কোটি ডলার অর্জন ছিল স্বপ্নের মতো। তবে এই চিত্র বদলেছে। সম্ভাবনা দেখে এ খাতে এসেছে বিদেশী উদ্যোগ। সামনে দেখা দিচ্ছে আরও সম্ভাবনা। ফলে এ অঞ্চলের এখন নুন আনতে পান্থা ফুরানোর দিন শেষ। আশ্বিন কার্তিকের সেই মঙ্গা বা অভাব নেই। এক সময়ের অভাবী পরিবারগুলোর এখন কর্মমুখী।
সূত্রমতে প্রতি বছরে সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন কোটি পরচুলা (উইগ) রফতানি হয়ে থাকে। বর্তমানে ৩৬ হাজার নারী কাজ করছে। কিন্তু বিশ্বে পরচুলার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই চাহিদা পূরনে সব জায়গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানায় গড়ে উঠেছে। কিন্তু বিশ্ব বাজারে পরচুলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তা সাব কন্ট্রাক নিয়ে গ্রামে গ্রামে পরচুলা কারখানা গড়ে তুলে।

সূত্রমতে ‘সাধারণত নারীরা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ানোর সময় চিরুনির সঙ্গে যে চুল উঠে আসে, যা তারা ফেলে দেন-এসব চুল ফেরিওয়ালা বা এজেন্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত চুলের কারখানাগুলোতে এসব চুল সরবরাহ করা হচ্ছে। পরচুলা কারখানার রুমানা হক জানান, এখানকার নারী শ্রমিকদের দুজন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ  শেখানো হয়। তারা ৭ দিনেই সব শিখে যায়। এখন এই সকল গ্রামের নারী সহজেই পরচুলা তৈরি করতে পারছেন।
কারখানায় এসব চুল প্রথমে নারী কর্মীরা জট ছাড়ান, তারপর শ্যা¤পু ও বিভিন্ন মেডিসিন ব্যবহার করে ধুয়ে প্রক্রিয়াজাত করে। এরপরের পর্যায়ে এসব চুল দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরি করা হয়।

৪ বাই ৪, ৫ বাই ৫ এবং ৪ বাই ১৩ সাইজের পরচুলা ক্যাপ তৈরি হয়ে থাকে। প্রকারভেদে প্রতিটি ক্যাপে ২০ গ্রাম থেকে ৫০ গ্রাম পর্যন্ত চুল লাগে। ক্যাপ তৈরিতে লাগে মাথার ড্যামি, চুল, নেট, সুচ, সুতা, চক ও পিন। এসব ক্যাপের উপকরণ স্থানীয় উদ্যোক্তারা ঢাকা থেকে নিয়ে এসে গ্রামের নারীদের দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরি করে রফতানিকরণ প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন।

স্থানীয়রা জানান, গ্রামে গ্রামে পরচুলার কারখানা হওয়ায় গ্রামের অনেক গরিব পরিবারের মেয়েরা কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এমনকি যারা লেখাপড়া করেন তারাও এখানে কাজ করে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। পরচুলা দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরির আগে ৭ দিন করে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরচুলা কারখানায় অষ্টম শ্রেণী শিক্ষার্থী মাজেদা আক্তার জানালেন সে স্কুলের  লেখাপড়ার পাশাপাশি পরচুলার কাজ করেন। গত ৫ মাস এ কারখানায় কাজ করে ২৫ হাজার টাকা আয় করেছে। মাজেদা জানায়, তার বাবা দিনমজুর। মা সংসার দেখাশোনা করে। বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে এ কারখানায় কাজ করছে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং স্কুল ছুটি হলে এ কারখানায় এসে কাজ করে।

গৃহবধূ সানজিদা আকতার বলেন, স্বামী দিনমজুর। অভাবী সংসারে দুই ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে এবং মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। স্বামীর অনুমতি নিয়ে সংসার সামলিয়ে গত দুই মাস থেকে কাজটি করছি। কাজ করার আগে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। ৫ বাই ৫ সাইজের ক্যাপটি করতে তিন দিন সময় লাগে। মজুরি পাওয়া যায় ৬০০ টাকা। গত দুই মাসে সংসার সামলিয়ে ৮ হাজার টাকা পেয়েছি। পরচুলা ক্যাপ আসার পর আমাদের মতো হতদরিদ্র পরিবারের সুবিধা হয়েছে।

উদ্যোক্তা আজাহার ইসলাম সুজন (২৭)। তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ছোট ব্যবসা করতেন। তিনি এভারগ্রিনের সঙ্গে কথা বললে তাকে কাজ দেয়া শুরু করেন। গত চার মাস থেকে এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আজাহার ইসলাম সুজন বলেন, আমার ছয়টি হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা আছে। যেখানে প্রায় দেড় শতাধিক দরিদ্র নারী ও শিক্ষার্থী কাজ করে। কাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সব খরচ বাদ দিয়ে এসব কারখানা থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়।

দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সবিতা রানী জানান, গত পাঁচ মাস থেকে পরচুলা থেকে ক্যাপ তৈরির কাজ করছেন। এখন কলেজ চালু হওয়ায় কাজ কম করতে পারছি। বাবার কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয় না। এ কাজ করে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। এ গ্রামের কারখানার দলের অধিনায়ক রশিদা বেগম বলেন, আমার অধীনে ২০ জন ক্যাপ তৈরির কাজ করে। এর মধ্যে ছয়জনই ছাত্রী। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি এ কাজ করে। আর গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করে। এ কাজ করে প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো আয় করে থাকি। এছাড়া দলের অধিনায়ক হিসেবে তদারকি করায় বাড়তি আরও কিছু টাকা দেয় মহাজন। যে টাকা উপার্জন করি, এতে সংসার এখন ভালভাবেই চলে।

অপর দিকে দেখা যায়, ইপিজেডের অভ্যন্তরে এভারগ্রিন পরচুলা কারখানায় একযোগে কাজ করে ১৫ হাজার নারী ও ১০ হাজার পুরুষ শ্রমিক। নারী শ্রমিকরা চুলের কাজ আর পুরুষ শ্রমিকরা প্যাকেটজাতের কাজ করে থাকে। সকাল সাতটার মধ্যে কারখানায় শ্রমিকেরা ঢুকে যান। দিনভর কাজ শেষে বিকেল চারটা থেকে একইভাবে বের হতে থাকেন শ্রমিকেরা। কেউ কেউ ওভারটাইম কাজও করেন। ইপিজেডের গেটে কথা হয় ভ্যানচালক আজিনুর ইসলামের (৩০) সঙ্গে। স্ত্রী কমলা বেগম প্রায় ৬ বছর যাবত ইপিজেডের পরচুলায় কাজ করছেন। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন গ্রামে পরচুলার ছোট কারখানায় মজুরি কম পাওয়া যায়। এখানে মজুরি বেশি। প্রতি মাসে স্ত্রীর আয় হয় ১৫ হাজার টাকা। তার আয়ের চেয়েও স্ত্রীর আয় বেশি। প্রতিদিন ভোরে তিনি নিজের ভ্যানে স্ত্রীকে দিয়ে যান এবং বিকেলে নিতে আসেন। স্ত্রীকে কারখানায় আনা- নেয়ার সময় ওই এলাকার অন্য শ্রমিকেরাও আসেন তার ভ্যানরিক্সায়। এতে আজিনুরের প্রতি মাসে বাড়তি আয় হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। বাবুল চন্দ্র রায় জানান, আগে তিনি কৃষিশ্রমিক ছিলেন। ইপিজেড হওয়ার আগে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় দৈনিক হাজিরা পেতেন। বাকি সময় রিক্সা চালাতে হতো। নিজের ভিটাটুকুও ছিল না। ইপিজেড হওয়ার পর তার তিন মেয়ে সেখানে কাজ পায়। তারা প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা রোজগার করছে। এখন নিজের একটা ভিটা হয়েছে। তিনটি টিনের ঘর দিয়েছেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওই গ্রামের আনোয়ারুল ইসলাম (৩০) ও তার স্ত্রী পারভীন আকতার (২৮) এভারগ্রিনে কাজ করেন। দুজনে মিলে আয় করেন মাসে ২৫ হাজার টাকা। আনোয়ারুল বলেন, প্রায় ১১ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন। মোটরসাইকেল কিনেছেন, বাড়ি পাকা করার কাজ শুরু করেছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি মোটরসাইকেলে চেপে ইপিজেড হতে বের দেখা যায়। পরিমল রায় (২৯) ও লক্ষ্মী রানী রায় (২৪)।

 পরচুলা তৈরির কারখানা এভারগ্রিনের সূত্রে জানানো হয়, তাদের কারখানার মোট শ্রমিকের ৬৫ শতাংশ নারী। তারা তিন ধরনের পরচুলা তৈরি করেন। বেশির ভাগই কার্নিভ্যাল উইগ ও সিনথেটিক উইগ। মানুষের পরিত্যক্ত চুল দিয়েও কিছু পরচুলা তৈরি হয়। রঙ- বেরঙের কার্নিভ্যাল উইগ উৎসবের দিনে লোকে শখের বশে মাথায় পরে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব থেকে দেখা যায়, পরচুলা রফতানির সিংহভাগই এভারগ্রিনের কারখানার।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, অপ্রচলিত এই পণ্যটি রফতানি করে প্রথমবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। ওই সময় পরচুলা রফতানি করে ১ কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেন উদ্যোক্তারা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরচুলা রফতানি করে আয় হয় ১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩ কোটি ২৫ লাখ ডলার হয়। করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে পরচুলা রফতানি এক লাফে বেড়ে ৫ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা পৌঁছায় ১০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারে।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

More News Of This Category

© All rights reserved © 2025 Coder Boss

Design & Develop BY Coder Boss