“নীহার গোমেজ” এর তিনটি কবিতা
Coder Boss
-
Update Time :
মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
-
৪৩
Time View
(১) চিঠি
“তোমার হাসি ভুবন ভরা আলো
তাই দেখে আমার মন জুড়ালো”
প্রিয় মেঘ,
অত্যাধুনিক যুগ। এখন আর কেউ কষ্ট করে , পাতার পর পাতা চিঠি লেখেনা।কারন নেটের যুগে সেই সময় কোথায়? চিঠির বদলে চ্যাট হয়। এখন পিয়নবাবুর দেখা মেলে কদাচিৎ। তবে আমেরিকায় রোজই পিয়নের দেখা মেলে কিন্তু প্রেম বা ভালবাসার চিঠি নয়। যত বিল বাট্টা , আর ক্রেডিট কার্ডের অদরকারী চিঠি।
চিঠি দুটি অক্ষরের নাম যেন মধু , শিহরন,আর ভালবাসায় ভরপুর।প্রিয়জনের চিঠি যেন বাঁচার, এগিয়ে যাওয়ার রসদ ।মাঝে মাঝে চিঠি পেতে ও আনন্দ, লেখার চেয়ে। জীবনে পেয়েছি কিন্তু দিয়েছি একটা দুটো।সত্তর আশি দশকে চিঠি পেতাম চালের কোনায়, রাস্তায়, অথবা বাচ্চাদের কোচরে। আর সেই চিঠি পড়া হতো টয়লেটে বা লুকিয়ে ।আজো সেই প্রথম দিনের প্রথম চিঠির শিহরন ঘামে ও ভয়ে জজর্রিত স্মৃতি।
আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বড্ড চিঠি লিখতে ইচ্ছে হলো।যে চিঠি হয়তো যৌবনে লেখার ছিল। কিন্তু অবুঝ মনের সবুজটা আজ আরমোরা ভেঙ্গে জেগে উঠেছে।
গতকাল ঠান্ডাটা স্বাভাবিক ছিল না।অলস বিকেলটা মন খারাপের। কফির স্বাদ টা ও বিস্বাদ। অনেক কথা বলার। মাঝে মাঝে কিছুই বলা হয়ে উঠেনা।ভর-শূন্য সময়ে নিজেকে অসহায় ভাবি আবার এও সত্যি তুমি আছো পাশে।অনেক দূরে, সাত সমুদ্র পেরিয়ে তোমার আস্থানা।একটাই ভালো যে,তুমি আমার চেয়ে বেশী জান ও চেন সবকিছু।যদিও সবাই বলে Internet-একযুগ ,হাতের মুঠোয় ধরা।কিছুটা সত্যি । সবটা নয়।এই সংযোগের অস্বীকার কেমন করে করি – তোমাকে পাওয়া। পেলেই কি হয়? ধরে ও রাখতে হয়। আর তার মাধ্যম লেখা আর বলা।কথায় হয়তো ফাঁকি থাকতে পারে। কিন্তু লেখায় তুমি নিবিষ্ট,কাগজ, কালি, আর মন তিনে মিলে চলে একসাথে।কখন ও মনটা পিছিয়ে যায়।লেখা হয়ে ওঠে বাঁধা বুলি।তাতে কিন্তু অন্তরের তুলিটা দাগ কাটে না।
তোমাকে দেখে দেখে চোখ বিশ্রাম পাক। হৃদয়ে জাগ্রত থাকুক টান।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আকর্ষক সেই নর আর নারী।সেই নর তুমি।আজ আর নয়।ভাল থেকো।
ইতি,
তোমার এক ফোঁটা শিশির ।
(২) চল্লিশ বছর….অতঃপর
ক্রিং ক্রিং
হ্যালো , কে বলছেন?
আমি “ অনুপম”
অনুপম তুমি ? কি করে পেলে আমাকে?কেমন আছ? কোথায় থাক?
বাপরে একসাথে এত প্রশ্ন? তোমাকে অনেক খুঁজেছিলাম। তোমার ঠিকানায় অনেক চিঠি ও পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তুমি কোন উত্তর করনি কেন?
আরে বোকা আমি তো চল্লিশবছর আগেই শহর ছেড়ে লন্ডনে । চিঠি পাব কি করে?
দুঃখিত নিশি আমি অনেক ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু কোটিবার তোমাকে মনে করেছি , ভেবেছি পলে পলে ।প্রতিটি মুহূর্তে।
কিন্ত কেন ভেবেছ? তোমার বউ সন্তান তারা কোথায়?
বউ? সন্তান? বিয়ে আর করলাম কোথায়। এই মনটা যে, নিশিতা দখল করে আছে আজীবন থাকবে।
অনুপম ।কি বলছ এসব?
সত্যি বলছি । তোমার সাথে শেষ দেখা হবার পর যতবার কাউকে নিয়ে ভেবেছি ততবারই ফিরে এসেছি পারিনি। এখন ষাট ছুঁই ছুঁই আর কি হবে বিয়ে করে তুমিই বল?
আজ আমাকে কি করে পেলে?
আমার এক বন্ধুর প্রোফাইলে ।বন্ধু লিষ্টে পেয়েছি। অথচ ফেসবুকে তোমার নাম দিয়ে কতশত বার সার্চ করেছি পাইনি। কারন তুমি অন্য নামে আইডি খুলেছ।
বিশ্বাস কর অনুপম আমিও তোমার নাম দিয়ে সার্চ করেছি অনেক অনেক বার পাইনি। তাছাড়া এদেশে জীবন যাপন সহজ নয়। সময় হয়নি নানা চাপে তাপে সংসারের ঝামেলাতে। একেবারে ভুলে গেছি কথাটা ঠিক নয়। মনের গোপন কুঠরীতে গোপনেই আছ। তুমিই বল এছাড়া আর কি করার ছিল।একটা মেয়ে আর কি করতে পারে?
তাই প্রেমের সমাধি নিজেই দিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিলাম।
তা তুমি এখন কোথায়?
দিল্লী ছেড়ে এখন নিজ শহরেই আছি। মা, ভাই কোভিডে চলে গেল। বোনটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়াতে এখন কর্ণাটকে আছি।
আমি সরি। আমার স্বামী, বাবা, মা ও চলে গেছে দূর আকাশে।
তোমার স্বামী? সে কি? কবে , কি করে?
হার্ট এট্যাক। আট বছর চলছে।
আমি সন্তানদের নিয়ে আছি। শোন এখন রাত তিনটা বাজে। কাল না না এখন প্রতিদিনই কথা হবে। এখন রাখি। বউমা হয়ত ভুল বুঝতে পারে। ভাল থাক । কাল সব বলব তোমাকে।
বাই নিশি।
বাই। বলেই মোবাইলটা রেখে দিল নিশিতা। কিন্তু ঘুম তো দূরে থাক সে ভাবতেই পারেনি এতগুলি বছর পর অনুপম ওকে মনে রাখবে, কল করবে।ছায়াছবির মত সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠল।ওদের প্রথম দেখা তারপর সব সব কিছু।নিশিতা মধ্যবিত্ত ঘরের আদুরের ছোট মেয়ে। হোষ্টেল থেকে ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে সবে নিজ গ্রামে গতরাতেই ফিরেছে।সদ্য ঘুম হতে উঠেই এক বালতি জল হাতে করে টয়লেটের দিকে যাবে ঠিক তখনই অচেনা অজানা দুজন কলের পাশে দাঁতে ব্রাশ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে । হঠাৎ চোখাচোখি অনুপমের সাথে। লজ্জায় নিশিতার মাথাটা অবনত। পা আর সামনে এগুচ্ছে না। ঠিক তখনি পাশের ঘরের কাকীমা বলে উঠল এরা অনন্তের বন্ধু। আমাদের চাপকলটা নষ্ট । তাই তোমাদের কলটা একটু ব্যবহার করবে।নিজেকে সামলে নিয়ে নিশিতা আবার ঘরে ফিরে গেল। আর অপেক্ষায় ছিল কখন এই আগুন্তুকদ্বয় সরবে।
মাঘ মাসের বিকেল। যদিও সূর্যের তেজ নেই তথাপি একটু ওম ভাব। উঠোন হতে শতকদম দূরেই শষ্যের জমিন। অনেকদিন পর নিতু আর নিশি হলুদ সরিষাফুলের রাজ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের কথা বলাবলি করছিল। সামনেই নজরে এলো সেই অচেনা দুইজন সাথে অনন্ত। অনন্ত পরিচয় করিয়ে দিল এরা দিল্লী হতে ওর সাথে বেড়াতে এসেছে। ওরা একসাথেই কাজ করে।দুই তিনদিন থাকবে। অনন্ত নিশিতাকে অনুরোধ করল সে যেন একটু সময় দেয়। গ্রামটা দেখায়। এদিকে নিশিতার বিয়ে নিয়ে পরিবারের লোকজন ব্যস্ত। সামনের সপ্তাহেই আংটি পড়াবে ।বিয়ে দুইমাস পরেই।
দুদিনের মধ্যেই অনুপম আর নিশিতা অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে।অদ্ভুত এক ভাললাগা দুজনের মধ্যে। কিন্তু কেউ কাউকে বলেনা। কাল ওরা চলে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করেই রাতে জ্বর বমি অনুপমের।তারপরদিন আর যাওয়া হয় না। জ্বরের মাত্রা যেন পারদকেও মানতে চায়না। মাথায় জল ঢালতে হবে । কিন্তু কাকীমা দের চাপকল নষ্ট। বয়স্কা কাকীমাকে সাহায্য করার জন্য নিশিতাকেই জল টেনেটেনে দিতে হলো। একটা সময় কেটলিতে জলের ধারা নিশিতাকেই অনুপমের মাথায় ঢালতে হলো। একদিনেই অনুপম দুর্বল হয়ে পড়েছে । কাঁচকলা আর ঝাউভাতও রেঁধে দিল। আসলে কাকীমা আর নিশিতাকে সকলেই ভাববে মা মেয়ে। একই উঠোন শুধু ঘর আর হাঁড়ি আলাদা হলেও নিশিতার জন্য কোন বাঁধা নিয়ম কানুন নেই। সাঁঝবাতি ধূপের কাজটাও নিশিতাই করে। হারিকেনের মৃদু আলোতে অনুপম নিশিতার হাত দুটি চেপে ধরে বলে এ ঋণ কখন ও শেষ করতে পারবনা। এই প্রথম কোন পুরুষের হাত নিশিতার হাত ছুঁয়েছে। কিছুটা বিহ্বল, এক অদ্ভুত শিহরন, হাতটা সরাতে ইচ্ছে করছে না। কতক্ষন দুজন দুজনকে ছুঁয়েছিল জানেনা। ঘোরলাগা এক সন্ধ্যালোকে দুজন ক্ষনিকের জন্য একে অপরের আরো কাছে । হঠাৎ করেই অনুপম নিশিতার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে প্রলম্বিত চুমুতে ভরিয়ে দেয়। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়েছিল দুজন। তাই এ ভাললাগা টুকু দুজনেই উপভোগ করে। তারপরদিন ও ওদের যাওয়া হয়না। ইতিমধ্যে কাকীমার কাছে নিশিতার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়। দিল্লী শহর আর বাংলাদেশ তো বাড়ীর পাশে আরশি নগর নয়। তাছাড়া অনুপমের সম্পর্কে কিছু জানেনা । তাই নিশিতার পরিবার নাকচ করে দেয়।অথচ নিশিতা কিন্তু চিনতে ভুল করেনা । অনুপম আর দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা। মানবিক ধর্মভীরু একজন বিশ্বাস যোগ্য । এ কথাটা কেউ বুঝতে চায়না বা বুঝাতে পারেনা।অনুপম নিশিতাকে তাঁর পাসপোর্ট আইডি ঠিকানা সব দেখায়। আজ বিকেলেই চলে যাবে এরা। একফাঁকে দুজন দুজনার হাত ধরে শপথ করে যেভাবেই হোক তারা এক হবেই। আপাতত চিঠি হবে যোগাযোগের মাধ্যম।মন খারাপ নিয়ে চোখের জলে দুজন দুজনকে বিদায় দেয়। অনুপম চলে যাবার পর নিশিতা বুঝতে পারে এটাই তার জীবনে প্রথম প্রেম।অনুপমের জন্য মনটা হু হু করেউঠে।দুফোঁটা নয় অনেক রাতই নিশিতা চোখের জলে বুক ভাসায়।মনের বিরুদ্ধে কিছুটা জোড় করেই বাবা মা লন্ডন থাকা অর্ঘের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের তিনমাসের মধ্যেই লন্ডন চলে যায়। এই তিনমাসে অনুপমের একটি চিঠিও ওর হাতে পায়নি। কারন নিশিতার বাবা সবগুলি চিঠি পুঁড়িয়ে ফেলত। অনুপম সব ভুলে গেছে ভেবেই আর কোন পদক্ষেপ নিতে পারিনি নিশিতা।অনুপমের অধ্যায়টা নিশিতা ইচ্ছে করেই ভুলে যায়। কারন দুটি সন্তানের মা।চল্লিশ বছরে কত কি বদলে গেছে। জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এখন সে শ্বাশুড়ী, দাদীমা। বয়সটা বেড়ে গেছে । চোখে চশমা উঠেছে, চামড়ায় ভাঁজ ধরেছে ।সারাদিন সংসার নাতী নাতনী নিয়ে কেটে যায়।
এত বছর পর পুরানা স্মৃতিটা আবার নতুন করে সামনে । কাল কি বলবে কি করবে ভেবে পায়না। তবে এটুকু বুঝতে পারে অনুপমের জন্য মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। বার বার। প্রশ্ন আসে কেন সে বিয়ে করেনি? কেন এ ত্যাগ? কাল জানতেই হবে।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।স্বপ্নে দেখে নিশিতা সংসার ছেড়ে অনুপমের হাত ধরে ট্রেনে উঠে বসেছে।অনুপম হাতটা ধরে আছে ।দূরগামী ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলছে সবকিছু পিছু ফেলে।মোবাইলটা ভু ভু শব্দ করছে হয়ত অনুপমের কল।একাকী এ বয়সে ভালবাসার মানুষ পাশে আছে ভেবেই মনটা অজানা আনন্দ লহরী তুলে। কি জানি অতঃপর কি ..,…।।
(৩) হৃদয়ের অনুভবে
অনিদ্রার ঘোরে হারায় নৈকট্য
রুটিন মাতাল মহুয়ার নেশা যায় টুটে
প্রয়োজন ফুরালে প্রিয়জন হয় দূরের
মনের ঘরে জমে বিষাদের ছায়া , মনকষ্ট।
মিথ্যে ,নষ্টামি,মিষ্টি বুলির বাহারে
কষ্ট বাড়ে আহারে,হৃদয় হয় চূরমার
জল বিহীন কলসী বাজে বেশী
তবু বেহায়া কলসী বাজে নিরন্তর।
যোজন যোজন দূরত্বে
ইচ্ছে করেই একে করেছি সম্বল
মনের আর্শীতে নিয়ত প্রতিবিম্ব
প্রতিদিনের মত অভ্যস্ত নিয়মে।
কখনও কানে বাজে দীপ্ত কন্ঠ
কখনও বা সুরের মোর্ছনা
নিঃশব্দ,নির্জন রাতে কিছু এলোমেলো শব্দ
আলোড়িত করে হৃদয় সায়রে অনবরত।
ভাবি বসে মনের সংগোপনে
অপেক্ষার প্রহর কাটে দিন রজনী
এক ফালি চাঁদের আড়ালে
লুকিয়ে রাখি নিজেকে।
মন যদি মনে হারায়
দূরত্ব , ব্যবধান কি আসে যায়
থাকনা অভিমানের অনুভবে
তবু ও আছি ছায়া সঙ্গী হয়ে।
নীহার গোমেজ, কবি ও লেখক, আমেরিকা।
Please Share This Post in Your Social Media
More News Of This Category
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.