অনেকেই মনে করেন, ধনী হওয়ার জন্য কেবল সঞ্চয় এবং বিনিয়োগই প্রয়োজন। তবে আমি বলব, ধনী হওয়ার পথটি শুধুমাত্র অর্থ সঞ্চয়ে নয়, বরং মানুষের কাছে কিছু দেওয়ার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে। এখানে ‘দেওয়া’র অর্থ শুধু টাকা পয়সা বা সম্পদ নয়, এটি আপনার সময়, আন্তরিকতা, পরামর্শ, এবং যত্নও হতে পারে। আপনি যত বেশি মূল্যবান কিছু দেবেন, মানুষ তত বেশি আপনার প্রতি আকৃষ্ট হবে, এবং সেখান থেকেই আপনি আর্থিক এবং মানসিক সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।
ধরা যাক, আপনি একজন কনসালটেন্ট। আপনার কাছে একজন ক্লায়েন্ট পরামর্শের জন্য আসেন এবং তার জন্য একটি নির্দিষ্ট ফি প্রদান করেন। এখন, আপনি যদি শুধু সেই নির্দিষ্ট ফি অনুযায়ী কাজ করেন, তবে ক্লায়েন্টের কাছে এটি একটি স্বাভাবিক লেনদেন মনে হবে। কিন্তু আপনি যদি তাকে তার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সেবা দেন, তাকে নিজের সমস্যার সমাধানে আরও গভীরভাবে সাহায্য করেন, তাহলে সে অনুভব করবে যে তার বিনিয়োগের চেয়ে বেশি মূল্য সে পেয়েছে। Harvard Business Review এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহককে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সেবা প্রদান করে, তাদের গ্রাহক ফিরে আসার সম্ভাবনা ৬৫ শতাংশের বেশি। ( সূত্র: হারভার্ড: হারভার্ড বিজনেস রিভিউ, জুন ২০১৭)
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অ্যামাজনের প্রাইম মেম্বারশিপ। এর সদস্যরা প্রায়ই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্রুত ডেলিভারি পান, যা তাদের কেনাকাটায় বাড়তি আনন্দ দেয়। এই অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার ফলে অ্যামাজনের প্রাইম মেম্বারশিপের সদস্যদের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণ গ্রাহকদের চেয়ে বেশি, যা প্রতিষ্ঠানটির আয়ের একটি বড় উৎস। ( সূত্র: ফোর্বাস, সেপ্টেম্বর, ২০২০)
আমরা প্রায়ই দেখি, ছোট ছোট ব্যবসা বা চায়ের দোকানে অনেক ভিড় থাকে। কারণ সেখানে গিয়ে মানুষ শুধু চা খেয়ে আসেন না, বরং মালিকের আন্তরিক ব্যবহার এবং বাড়তি যত্নও পেয়ে থাকেন। গ্রাহকরা এমন জায়গায় বারবার ফিরে যান যেখানে তারা ভালো সেবা এবং আন্তরিক আচরণ পেয়েছেন। ফোর্বাসের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কাস্টমার সার্ভিসে বেশি মনোযোগ দেয়, তাদের ব্যবসায়ের সাফল্যের হার প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি। ( সূত্র: ফোর্বাস, নভেম্বর ২০১৯)
এখানে মূল কথা হলো, আপনি যখন আপনার গ্রাহক বা ক্লায়েন্টদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু দেন, তখন তারা আপনার প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠে এবং বারবার আপনার কাছে ফিরে আসে। এটি ব্যবসায়িক সফলতার একটি বড় চাবিকাঠি।
মানুষকে বেশি দেওয়ার আরেকটি দিক হলো, এটি সম্পর্ক তৈরি এবং নেটওয়ার্কিংয়ে সাহায্য করে। আপনি যদি কারও সাথে খোলামেলা কথা বলেন, তার প্রশংসা করেন বা তাকে কোনও ভালো পরামর্শ দেন, তখন সেই মানুষটি আপনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে
বলা হয়েছে, সামাজিকভাবে সফল মানুষরা সবসময় অন্যদের বেশি দেওয়ার প্রবণতা রাখেন, যেমন আন্তরিকতা, সহযোগিতা, এবং সময়। এই বাড়তি মনোযোগের ফলে তাদের নেটওয়ার্কিং উন্নত হয়, যা পরবর্তীতে পেশাগত সাফল্যে ভূমিকা রাখে। (সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, জুলাই ২০২০)
উদাহরণস্বরূপ, একজন সফল ব্যবসায়িক নেতার কথা চিন্তা করুন, যিনি কেবল তার ব্যবসার উন্নতিতে মনোযোগ দেন না, বরং তার কর্মচারীদের জন্যও অতিরিক্ত সময় দেন। এ ধরনের নেতা কর্মচারীদের মন জয় করে, এবং তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আরও ভালো ফলাফল প্রদান করে।
আপনার অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, আপনি যদি সবসময় নিজের লাভের কথা চিন্তা করেন এবং কম দেওয়ার চিন্তায় থাকেন, তাহলে আপনি নিজে লাভবান হতে পারবেন না। হারভার্ড রিভিউয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সবসময় অধিক মুনাফার কথা চিন্তা না করে নিজেদের আন্তরিকতার মাধ্যমে মানুষকে কিছু দেয়, তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাফল্য অধিক হয়। ( সূত্র: হারভার্ড বিজনেস রিভিউ, মে ২০১৯)
আপনার আচরণে, ব্যবহারিক জীবনে এবং পেশাগত ক্ষেত্রে অন্যদেরকে কিছু বাড়তি দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি হতে পারে একটি ছোট হাসি, একটি সুন্দর কথা, অথবা একটি ভালো পরামর্শ। মানুষ এসব ছোট ছোট উপহারকে মূল্য দেয়, এবং এর ফলে তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক শক্তিশালী হয়।
বেশি দেওয়ার ধারণাটি কেবল অর্থ প্রদান নয়, বরং সেবা এবং আন্তরিকতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনি যে পণ্য বা সেবা প্রদান করেন, সেটি গ্রাহকদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যথেষ্ট কিনা তা নিশ্চিত করা জরুরি। আপনি যদি শুধু লাভের দিকে মনোযোগ দেন এবং গ্রাহকদের চাহিদা উপেক্ষা করেন, তাহলে আপনার ব্যবসা বা পেশাগত জীবন ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সেবা প্রদানে আন্তরিকতা এবং অতিরিক্ত মূল্য দেন, তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি। (সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, আগস্ট ২০২০)
আপনি যখন অন্যদের বেশি দিতে শুরু করবেন, তখন ধনী হওয়া কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক এবং মানসিক দিক থেকেও আসবে। আপনি যাদেরকে বেশি দিবেন, তারা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং ভবিষ্যতে আপনার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাবে।
অতএব, আপনি যদি ধনী হতে চান, তাহলে অন্যদেরকে বেশি দিতে শিখুন—এটি হতে পারে একটি সুন্দর আচরণ, একটি মূল্যবান পরামর্শ, অথবা একটি আন্তরিক সেবা। আপনার এই দেওয়ার অভ্যাসই আপনাকে সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, বিজনেস অ্যান্ড ফাইনান্স স্ট্রাটেজিস্ট অ্যান্ড পার্সোনাল ফাইনান্স এক্সপার্ট