ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই জটিল ও সংঘর্ষপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের। তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে, কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ দেশ দুটির মাঝে ভয়াবহ এক সমস্যা, যা একাধিকবার যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ আর রক্তক্ষয়ী ইতিহাসে বহুবার যুদ্ধের দামামা বেজেছে। কখনো ধর্মকে পুঁজি করে, কখনো বা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকার বরফঢাকা পর্বত থেকে শুরু করে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকা পর্যন্ত, বহুবার এই দুই দেশের সীমান্ত রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। কখনো তা ছিল আকস্মিক আক্রমণ, কখনো সীমান্ত রক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা, আবার কখনো আদর্শের লড়াই। প্রশ্ন থেকেই যায় তাহলে এখনো পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের মোট কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর এই যুদ্ধে কারাইবা জয়ী হয়েছে? এ নিয়েই আজকের প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন_____ সৈয়দ আবু মকসুদ।
ভারত ভাগের পর, ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান সমর্থিত একটি বিশেষ বাহিনী কাশ্মীরে হামলা চালায়। এর ফলস্বরূপ ভারত সেখানে সেনাবাহিনী পাঠায় এবং দুই দেশের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। যুদ্ধের ফলে কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান।
‘কচ্ছ’ অঞ্চলে দ্বন্দ্বটির সূচনা হয় ১৯৫৬ সালে। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতের গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ অঞ্চলে সীমান্ত দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সে বছর ৮ এপ্রিল, উভয় দেশ সীমান্ত চৌকিতে আক্রমণ চালায়, যা পরবর্তীতে বড় আকার ধারণ করে। প্রথমে শুধু উভয় দেশের সীমান্ত পুলিশরা এ সংঘর্ষে জড়িত হয়। পরে খুব দ্রুত উভয় দেশের সশস্ত্রবাহিনীও এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের মধ্যস্থতায় দুই দেশ যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হয়। ১৯৬৮ সালে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে পাকিস্তান কচ্ছ অঞ্চলের ৩,৫০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ৩৫০ বর্গকিলোমিটার ভূমির অধিকার পায়।
একই বছর, আগস্ট মাসে পাকিস্তান অপারেশন জিবরাল্টার নামে একটি গোপন অভিযানের মাধ্যমে কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে। এতে ভারত পাল্টা হামলা চালায় এবং পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ শেষ হয়। এই চুক্তি দুই দেশকে যুদ্ধ পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা দেয়।
১৯৯৯ সালের মে থেকে জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনা ও গেরিলারা ভারতের কার্গিল অঞ্চলের বিভিন্ন উচ্চভূমি দখল করে নেয়। এতে শুরু হয় কার্গিল যুদ্ধ। ‘অপারেশন বিজয়’ নামে সামরিক অভিযান চালিয়ে এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করে ভারত। আন্তর্জাতিক চাপ এবং ভারতের কূটনৈতিক সাফল্যের ফলে পাকিস্তানকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনী জড়িত থাকলেও সরকার প্রাথমিকভাবে তা অস্বীকার করে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সিআরপিএফ সদস্য নিহত হন। জইশ-ই-মুহাম্মদ নামের একটি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে একটি বিমান হামলা চালায়। পরদিন পাকিস্তান পাল্টা বিমান হামলা চালায়। এ ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আসে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পাহালগামে পর্যটকদের ওপর হামলা হয়েছে। এতে ২৬ জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন গত ২২ এপ্রিল। ঐদিন বিকেলে পাহালগামের বাইসরন উপত্যকায় অস্ত্রধারীরা পর্যটকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুড়লে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। যা ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর চালানো যেকোনো হামলার তুলনায় ভয়াবহ। যে ঘটনাকে ইস্যু করে ভারত পাকিস্তান একে অন্যের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তে থেমেথেমে চলছে উত্তেজনা বিরাজ করছে, ঘটছে গুলাগুলির ঘটনাও। সেই হামলা-পাল্টা হামলাই এখন মোড় নিচ্ছে বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান-ভারতের প্রতিটি সামরিক সংঘর্ষ মূলত কাশ্মীর ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে শুরু হলেও তা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসব যুদ্ধ-সংঘাতের বাইরেও বিভিন্ন সময়ে ভারত-পাকিস্তান বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ পর্যন্ত যতগুলো সংঘাত বা যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবই ঘটেছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। পারস্পরিক সহনশীলতা এবং স্থায়ী কূটনৈতিক সমাধানই এ সমস্যা থেকে অঞ্চলটিকে মুক্তি দিতে পারে।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.