মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির ঘনঘটার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানে দেখা গেছে নাটকীয় পরিবর্তন। একসময় ইরানে হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে ধৈর্যের আহ্বান জানান তিনি। কয়েক ঘণ্টা আগেও সামরিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে সতর্ক করেন ট্রাম্প। তার ভাষ্য ছিল, এটি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান পরমাণু আলোচনাকে ভেস্তে দেবে। এখন তিনি ইউটার্ন নিয়ে ইসরায়েলি হামলাকে ‘চমৎকার’ ও ‘অত্যন্ত সফল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এর জন্য ইরানকেই দায়ী করে তিনি। এও ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরায়েলের ওপর হামলা হলে আমেরিকা তাদের রক্ষা করবে।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, যদি ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করা হয়, তাহলে আমেরিকা তা রক্ষা করবে। আমরা জানি না এর শেষ কীভাবে হবে, কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর ইরান ইসরায়েল এবং আমেরিকার জন্য এক গভীর হুমকি।
এর আগে ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার আহ্বান জানান ট্রাম্প। তার ভাষায়, ইরানের পারমাণবিক বোমা থাকতে পারে না। আমি আশা করি, তারা আলোচনায় ফিরবে।
তবে রয়টার্সকে দেওয়া এক ফোন সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প স্বীকার করেন, ইসরায়েলের এই হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি এবং তার প্রশাসন আগে থেকেই জানতেন। অথচ মাসের পর মাস ধরে তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হামলা বিলম্বের অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন, যাতে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য সময় পাওয়া যায়।
ট্রাম্প বলেন, আমি ইরানকে অপমান ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আমি তাদের রক্ষা করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি, কারণ আমি চাইতাম একটা চুক্তি হোক। ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর তিনি আবার বলেন, তারা এখনো একটি চুক্তি করতে পারে, এখনো দেরি হয়ে যায়নি।
এই পাল্টা অবস্থান থেকেই ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাকে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি বলেন, এই হামলা ছিল চমৎকার ও অত্যন্ত সফল। ট্রাম্পের এই মন্তব্যে স্পষ্ট, যদিও তিনি কূটনৈতিক আলোচনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু একইসঙ্গে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে ইসরায়েলকেও খোলাখুলিভাবে সমর্থন করছেন।
এদিকে, ইরান পাল্টা হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, এমন প্রশ্নে ট্রাম্প স্পষ্ট করে জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে থাকবে। তার কথায়, আমরা ইসরায়েলের খুব কাছের। আমরাই তাদের এক নম্বর মিত্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক বিবৃতিতে বলেন, শুক্রবার রাতে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এই হামলায় জড়িত নই। তবে মার্কিন বাহিনীকে রক্ষা করা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। রুবিও আরও জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রশাসন আমাদের বাহিনীকে সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। ইরানের উচিত নয় মার্কিন স্বার্থ বা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করা। পরে, যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানান, ইরানের ছোড়া কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে ইসরায়েলকে সহায়তা করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্প প্রশাসনের কূটনৈতিক ভাষা ও সামরিক বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। একদিকে আলোচনার আহ্বান, অন্যদিকে সরাসরি হামলার প্রশংসা—এ যেন ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত ভূমিকার প্রতিচ্ছবি।
এদিকে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনি বাধ্যবাধকতা রক্ষায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে ভোটদান থেকে ভারতের বিরত থাকার সিদ্ধান্তকে ‘লজ্জাজনক’ এবং ‘হতাশাজনক’ বলে অভিহিত করেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র। শনিবার (১৪ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী লিখেছেন, ‘এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং হতাশাজনক যে, ফিলিস্তিনের গাজায় বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইনি ও মানবিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘে গৃহীত এক প্রস্তাবে আমাদের সরকার ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ পর্যন্ত ষাট হাজারের বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু, ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত হয়েছেন। গোটা একটি জনগোষ্ঠীকে অবরুদ্ধ করে, খাদ্য ও ওষুধ থেকে বঞ্চিত করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ভারত সরকার নিরপেক্ষতার নামে কোনোরকম অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটা শুধু রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা নয়, বরং আমাদের উপনিবেশবাদবিরোধী ঐতিহ্যের এক করুণ বিপরীত যাত্রা। এমন এক সময়ে, যখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিযানে নেমেছে, তখন আমরা শুধু নীরবই নই, বরং যখন তার সরকার ইরানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে সে দেশের নেতৃত্বকে হত্যা করছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে, তখনও আমরা প্রশ্নহীনভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছি।
প্রশ্ন উঠছে— আমরা কি একটি জাতি হিসেবে আমাদের সংবিধানের নীতি এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধকে বিসর্জন দিচ্ছি? সেই সংগ্রাম তো ছিল শান্তি, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে। যেই নীতিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে ভারত বিশ্বমঞ্চে একসময় ন্যায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল— আজ সেই পথ থেকে সরে দাঁড়ানো কি আমাদের জন্য সম্মানজনক? এর কোনো ন্যায্যতা থাকতে পারে না। সত্যিকারের বিশ্ব নেতৃত্ব মানে শুধু কূটনৈতিক হিসেব-নিকেশ নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষ নেওয়ার সাহস। অতীতে ভারত এই সাহস দেখিয়েছে। বারবার।
আজকের বিশ্ব ক্রমেই বিভক্তির দিকে এগোচ্ছে। এই সময়েই প্রয়োজন মানবতার পক্ষে ভারতের কণ্ঠস্বর পুনরুদ্ধার করা— সত্য ও অহিংসার পক্ষে নির্ভীক অবস্থান নেওয়া। তবেই ভারত তার নৈতিক নেতৃত্বের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
সূত্র: রয়টার্স, ফক্স নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস।