ফিলিস্তিন, এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংঘাত, দখলদারিত্ব, এবং মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস রচিত হয়ে আসছে। আজকের দিনে এই সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিদিন নতুন প্রাণ ঝরে পড়ছে, ধ্বংসের মাত্রা আরও বাড়ছে। ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার লড়াই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এতকিছুর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা যেন সীমাবদ্ধ কূটনৈতিক বিবৃতি এবং প্রতীকী নিন্দার মধ্যে। প্রশ্ন ওঠে বিশ্ব বিবেক কি আজও জীবিত, নাকি এটি শুধুই ক্ষমতার রাজনীতির শিকার? ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি মানবাধিকারের সবচেয়ে জঘন্য লঙ্ঘনের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে গাজা উপত্যকা, যেখানে সংঘাত এবং দখলদারিত্বের কারণে লাখো মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে, খাদ্য ও পানির সংকটে ভুগছে, চিকিৎসা সেবা পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
গাজার বিভিন্ন শহর ও গ্রামে বোমা হামলা প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, এমনকি বাসস্থানও এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের মৃত্যু যেন কেবল একটি সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক মা-বাবা সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকছে, আবার কেউ কেউ নিজের পরিবার হারিয়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, ডাক্তার ও নার্সদের অভাব তীব্র। এমনকি যেসব হাসপাতাল চালু আছে, সেগুলোর ওপরও হামলা হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ অপরাধ। খাদ্য ও পানির সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে হাজারো শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং বিশুদ্ধ পানি না থাকায় রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ইসরায়েলের দখলদার নীতির ফলে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। পশ্চিম তীরের বসতি সম্প্রসারণ নীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে সেখানে ইসরায়েলি বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়া, গাজায় প্রায়শই বিমান হামলা এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, যেখানে অসংখ্য নিরীহ প্রাণহানি ঘটছে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ বা ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ এই স্লোগানের আড়ালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, অনেক সময় চিকিৎসা দল এবং সাংবাদিকদেরও লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে, যাতে প্রকৃত তথ্য বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে না পারে। এভাবে, ফিলিস্তিন সংকটের সত্যিকারের চিত্র বহুবার ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্ত থেকে যাচ্ছে। যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন অঞ্চলে মানবাধিকারের জন্য কড়া অবস্থান গ্রহণ করে, সেখানে ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তাদের নীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিমুখী। জাতিসংঘ একাধিকবার ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে, কিন্তু তা কোনো কার্যকর ফলাফল বয়ে আনেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু পশ্চিমা শক্তি ইসরায়েলকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। শুধু আর্থিক সাহায্যই নয়, তাদের কূটনৈতিক সহায়তার কারণেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নেওয়া অনেক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিনের পক্ষে যে কোনো প্রস্তাব তুললে তা ভেটো করা হয়।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী আরব দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদিও তারা ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে, কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। মুসলিম বিশ্ব কি সত্যিই ফিলিস্তিনের জন্য এক হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে, নাকি রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে? ফিলিস্তিন সমস্যার মূল কারণ হলো দখলদারিত্ব এবং ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতি। এই সংকট সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে: ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের নীতিকে কার্যকর করতে হবে। দখলদার নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে, যেমনটা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে করা হয়েছিল। জাতিসংঘকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, কেবল বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ফিলিস্তিনে খাদ্য, ওষুধ এবং পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়াতে হবে। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রকৃত তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছায়। ফিলিস্তিনের রক্তগঙ্গার সামনে বিশ্ব বিবেক কতটা কার্যকর, তা আজ একটি বড় প্রশ্ন। একদিকে মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো হয়, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয়। এটি কেবল নৈতিকতার পরাজয় নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির বাস্তব চিত্র।
আজ যদি ফিলিস্তিনের জন্য বিশ্ব একত্রিত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক জাতি এমন দুঃসহ পরিণতির শিকার হবে। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে যদি বিশ্ব দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে, তাহলে একদিন এই ন্যায়বিচারের অভাবের শিকার তারাই হবে। ফিলিস্তিনের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব শুধু তাদের নয়, বরং গোটা বিশ্বের। এখন সময় এসেছে এই রক্তগঙ্গার সামনে নীরবতা ভাঙার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, এবং বিশ্ব বিবেককে আবার জাগানোর। প্রশ্ন একটাই আমরা কি সেই দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত?
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.