– জিয়া হাবীব আহ্সান, এডভোকেট
প্রফেসর এম এ তাহের খান কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে মনে করি না । তিনি ছিলেন একজন জননন্দিত বহুমাত্রিক প্রতিভাধর মানুষ।অবিসংবাদিত চিকিৎসক ও সমাজসেবক । চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি এদেশে মেডিকেল শিক্ষার প্রসারে ও স্বাস্থ্যসেবায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মা ও শিশু হাসপাতালের জন্য তাঁর দেয়া শ্রম ও সাধনা অতুলনীয় । তিনি সমাজসেবায় আমাদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবেন । একটি আধুনিক হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । তিনি দেশের আধুনিক অবসট্রেটিক্স এন্ড গাইনোকোলজির অন্যতম প্রবক্তা। তিনি অবৈতনিকভাবে ৫ বছর মা- শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করেন । তাঁর দক্ষ নির্দেশনা ও পরিচালনায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ আজ দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হিসেবে সমাদৃত। তাঁর তিরোধান চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও দেশের চিকিৎসক সমাজের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি। অধ্যাপক ডাঃ এম এ তাহের খান ১৯৪৪ সালের ১লা জানুয়ারী লক্ষীপুর জেলার বারালিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এম ফজলুর রহমান এবং মাতার নাম জোবেদা খাতুন। তিনি ১৯৫৯ সালে দত্তপাড়া হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬২ সালে করটিয়া সাদাত কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।ডা.এম এ তাহের খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) এমবিবিএস ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সুদর্শন, ব্যক্তিত্ববান ও স্পষ্টবাদী ছিলেন । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান (গাইনী) হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন । গাইনী সার্জারিতে তিনি বহু নতুন টেকনিক বা কৌশলের জন্ম দেন যা অপারেশনের জটিলতা কমাতে সাহায্য করে । শিক্ষক হিসাবে তিনি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের নিকট খুবই জনপ্রিয় আদর্শ শিক্ষক ছিলেন । তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী ও মেধাসম্পন্ন ছিলেন । তাঁর বক্তব্য ছিল পরিস্কার ও বাচনভঙ্গি চমৎকার । জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি মহান প্রভুর সন্তুষ্টির চেষ্টায় কাজ করে গেছেন । তিনি এতদাঞ্চলে মান্দাতার আমলের গাইনী চিকিৎসা পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন । এ মহান ব্যক্তিত্বের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ।
তিনি ১৯৭২ সালে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং ১৯৭২ থেকে – ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে আয়ারল্যান্ড থেকে DGO, ১৯৮২ সালে লন্ডন থেকে MRCOG ডিগ্রি এবং ১৯৯৪ সালে লন্ডন থেকে FRCOG ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জন তাকে এফসিপিএস-এ ভূষিত করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি হন এবং ১৯৯২ সালে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটিতে ১৯৯৯-২০০১ ও ২০০৩-২০০৮ মেয়াদে সদস্য হিসেবে এবং ২০০৮-২০২১ সাল পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০২১-২০২৪ মেয়াদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ( ১৫/০৭/২০২৩ পর্যন্ত) সফলভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর এম এ তাহের খান চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি এই মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল (অনারারী) হিসেবে জুন’২০০৬-২০১০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যার ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ আজ দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও সমাদৃত। তিনি বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির প্রেসিডেন্ট, ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখার প্রেসিডেন্ট এবং ওজিএসবি কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিকিৎসা সমাজের নেতৃত্ব দেন । এছাড়াও প্রফেসর এম এ তাহের খান বিভিন্ন একাডেমিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার ৩০ টিরও বেশি গবেষণাধর্মী প্রকাশনা রয়েছে। তিনি ওজিএসবি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ টিচার্স ফোরাম, এফএসএসবি ও বায়তুশ শরফ থেকে ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তাঁর সহধর্মীনি ডাঃ ফজিলাতুন নেসা যিনি ওজিএসবি-এর একজন সদস্য। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। জ্যেষ্ঠ সন্তান নাদিয়া ইয়াছমিন তাহের খান স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাপনায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং দ্বিতীয় সন্তান ডাঃ নাটালী জেসমিন তাহের খান যুক্তরাজ্যে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যায় প্রশিক্ষিত একজন চিকিৎসক ।তাঁরা দুজনই বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল পরিচালনা পরিষদের প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব প্রফেসর ডাক্তার এম এ তাহের খান ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ১৬ জুলাই ২০২৩ ইং সকালে নগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি স্ত্রী, ২ কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়–স্বজন ও গুণাগ্রাহী রেখে গেছেন । চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অবস এন্ড গাইনী বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর (ডা.) এম এ তাহের খানের মৃত্যুর খবরে মা ও শিশু হাসপাতালের কার্যনির্বাহী পরিষদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র- ছাত্রী সহ সমগ্র চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে । ১৭ জুলাই ২৩ বেলা ১১ টা ৩০মিঃ থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত মরহুমের কফিন শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হাসপাতাল লবিতে রাখা হয় এবং বাদ আসর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে নগরীর বিপুল সংখ্যক সর্বস্তরের নাগরিক অংশ গ্রহন করেন। জানাজা শেষে নাসিরাবাদ এমইএস কলেজ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়েছে।
এ মহান আলোর দিশারী মরহুম তাহের খান দেশ ও জাতির খেদমতে সারাজীবন কাজ করে গেছেন, মহান আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল নেক আমল কবুল করেন, গুনাহখাতা মাফ করে তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে দিন আমীন।
লেখকঃ আজীবন সদস্য, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন- বিএইচআরএফ
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.