ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া যুদ্ধ দেশ দুটির রাজনৈতিক ইস্যুকে ছাপিয়ে যেন ফ্রান্সের রাফাল যুদ্ধবিমান আর চীনের জে-১০সি ভিগরাস ড্রাগন যুদ্ধবিমানের শ্রেষ্ঠত্বে লড়াইয়ে পরিণত হয়। খবরটি বিশ্বজুড়ে হয় আলোচিত। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দাবি, তারা আকাশপথে সংঘর্ষের সময় একাধিক ভারতীয় রাফাল বিমান ভূপাতিত করে। সত্যিই এমনটি হয়ে থাকলে এটি হবে ফরাসি ডেস্যু কোম্পানির তৈরি বিমানের প্রথম পরাজয়। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ে ন্যাটো জোট সদস্যের বা শক্তিধর পশ্চিমাদের যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে চীনা সামরিক শক্তির এটিই প্রথম বিজয় বলা যেতে পারে। চীনা প্রতিষ্ঠান চেংডু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি জে-১০সি যুদ্ধবিমানের মূল্য ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত পাকিস্তানই চীনের বাইরে এই ফাইটারজেটের একমাত্র ব্যবহারকারী। অন্যদিকে গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতার রাফাল কিনেছে। গত মাসে ভারত তার বিমান বহরে আরও ২৬টি রাফাল যুক্ত করার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাফাল এবং জে-১০সি দুটোই ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। এর মানে, কম উন্নত বিমানের তুলনায় এগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো পুরোপুরি পঞ্চম প্রজন্মের গুণমান ধারণ করে না। ফরাসি যুদ্ধবিমানটিকে ৪.৫ প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানগুলোর মধ্যে একটি মনে করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে জে-১০সি-র তুলনা কীভাবে হয়?
রাডারের পার্থক্য :
রাফাল এবং জে-১০সি দুটো যুদ্ধবিমানেই উন্নত অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে (AESA) রাডার আছে। কিন্তু শক্তি এবং লক্ষ্যবস্তু শনাক্তকরণে দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাফাল একটি আরবিই২-এএ এইএসএ রাডার ব্যবহার করে। এটির ব্যাস প্রায় ৬০০ মিলিমিটার (২৩.৬ ইঞ্চি) এবং এটি প্রায় ২০০ কিলোমিটার (১২৪ মাইল) শনাক্তকরণ পরিসরসহ ১৪০ ডিগ্রি এলাকা স্ক্যান করতে পারে। জে-১০সি বিমানের রাডারের ধরন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে এটির ব্যাস ৭০০ মিলিমিটারের (২৭.৬ ইঞ্চি) বেশি বলে জানা গেছে। এর মানে, এটির পৃষ্ঠতল অনেক বড় এবং রাফালের তুলনায় আরও বেশি রেডিয়েটিং অ্যারে ইউনিট রয়েছে। এটি বিমানবাহী রণতরী এবং ভূমিতে থাকা ঘাঁটি থেকে পরিচালনা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। অর্থাৎ, রাফালের রাডার সবচেয়ে শক্তিশালী নাও হতে পারে। পরিস্থিতিগত সচেতনতার ক্ষেত্রে জে-১০সি সম্ভবত আরও ভালো। তবে বিমানটি এতে স্থলভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা রাডার বা উড়ন্ত প্রাথমিক সতর্কতা এবং নিয়ন্ত্রণ (AEW&C) বিমান থেকে পাঠানো কোনো তথ্য সহায়তা আমলে নেয় না, যা একটি আধুনিক আকাশযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জে-১০সি বিমানগুলো চীনের তৈরি অন্যান্য সামরিক ব্যবস্থার সঙ্গে সহজ ডেটা লিংক করার সুবিধা পেতে পারে। অন্যদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী ফরাসি যুদ্ধবিমানগুলোকে দেশটির কাছে থাকা রাশিয়ান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ইসরায়েলি উড়ন্ত প্রাথমিক সতর্কতা এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে পারে।
অস্ত্রশস্ত্র :
জে-১০সি বিমানের অস্ত্র ধারণক্ষমতা অনেক কম। এর ১১টি হার্ডপয়েন্টে মোট সর্বোচ্চ বাইরের লোড ৬ টন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর হাতে থাকা রাফালের ক্ষেত্রে এটি ৯ টন। এর ১৪টি হার্ডপয়েন্টে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্রসহ বড় পরিসরের ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা বহন করা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ (BVR) ক্ষেপণাস্ত্র। আলোচিত ওই সংঘাতে ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশই তাদের নিজস্ব হিসাব অনুসারে নিজেদের আকাশসীমার মধ্যে থেকে আক্রমণ চালায়। জে-১০সি যুদ্ধবিমানের তালিকায়, সেরা বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ আকাশ থেকে আকাশে ছোড়ার ক্ষেপণাস্ত্র হল পিএল-১৫। এই প্রথম এটি সংঘাতে ব্যবহার করা হলো। এতে একটি এইএসএ রাডার সিকার এবং মিডকোর্স ডেটা আপডেট রয়েছে। এটি মাক ফোর অর্থাৎ শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ গতিতে ছুটতে পারে। দেড় মিলিয়ন পাউন্ড দামের একেকটি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। যদিও পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করা পিএল-১৫ই রপ্তানি সংস্করণের পাল্লা কম, ১৪৫ কিলোমিটার বলে জানা গেছে। শুধু জে-১০সি নয়, তুলনামূলক কম উন্নত জেএফ-১৭ ব্লক ৩ যুদ্ধবিমানেও পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করার প্রমাণ আছে। ২১০ কেজি ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডে ২০ থেকে ৩০ কেজি ওজনের উচ্চশক্তির বিস্ফোরক থাকে। চীনের এমন মারণাস্ত্র মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীকে এর চেয়েও উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে বিনিয়োগে বাধ্য করেছে। ছুঁড়ে দেওয়ার পর উড়তে থাকা অবস্থায় পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটি একটি সক্রিয় ইলেকট্রনিক স্ক্যানড অ্যারে রাডারের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুর দিকে পাঠানো হয়। এতে করে যে বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয়েছে তা শত্রুপক্ষের আক্রমণ এড়াতে নিরাপদে সরে যেতে পারে। রাডারটি লঞ্চ সিস্টেম বা একটি পৃথক বাহনে রাখা যায়। লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি গিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি তার নিজস্ব এইএসএ রাডার চালু করে, লক্ষ্যবস্তুকে লক করে এবং দারুণ নির্ভুলতার সঙ্গে আঘাত হানে। পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রে আছে ডুয়াল-পালস মোটর। তার মানে হলো, প্রাথমিক বিস্ফোরণটি স্তিমিত হওয়ার পর লক্ষ্যবস্তু থেকে ১০ কিলোমিটার বা তারও বেশি দূরত্বের মধ্যে দ্বিতীয় গতির বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। অন্যদিকে, রাফাল বিমানে আকাশ থেকে আকাশে ছোড়ার মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এটি এইএসএ রাডার সিকার দিয়ে চলে। ওড়ার সময় এতে দ্বিমুখী ডেটা লিংক ব্যবহার করা হয়। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কঠিন জ্বালানিযুক্ত র্যামজেট মোটর দিয়ে চলে। সর্বোচ্চ ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লার ওই ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বোচ্চ গতি মাক ফোর বা শব্দের চারগুণ। পাকিস্তানের ভূমিতে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভিযানে মেটিওর ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয় বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষের ছবিতে দেখা যায়, তা সম্ভবত আকাশ থেকে আকাশে ছোড়ার এমআইসিএ ইনফ্রারেড ক্ষেপণাস্ত্র বহন করছিল। সেগুলোর পাল্লা মাত্র ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার।
ইঞ্জিন এবং জটিল বাঁক নেওয়ার ক্ষমতা :
রাফাল এবং জে-১০সি দুটিই মাঝারি ওজনের যুদ্ধবিমান। এগুলো দেখতেও প্রায় একই রকম। অনেক দিক থেকে এদের মধ্যে মিল আছে। দুটিই বিমানেই ক্যানার্ড-ডেল্টা উইং ডিজাইন রয়েছে, যা জটিল বাঁক নেওয়া, উঁচুতে ওঠা এবং স্থির থাকার জন্য বিমানগুলোর আদর্শ গঠন তৈরি করে। এতে বিমানগুলো উচ্চগতিতে ছুটতে পারে। এমন গঠন শত্রুর সঙ্গে অল্প দূরত্বের মধ্যে যুদ্ধ করার জন্য বিমানগুলোকে ক্ষিপ্র গতি দেয়। ১৭ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার চওড়া জে-১০সি বিমানের মোট ওজন ১৪ টন। আর রাফাল ১৫ মিটার লম্বা, ১১ মিটার চওড়া। এর ওজন ১৫ টন। রাফালের টেক-অফ ওজন ২৪ টন বেশি। চীনের জে-১০সি বিমানের বেলায় তা ১৯ টন। বিমানটির সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মিটার উঁচুতে উড়ে কাজ করতে পারে। রাফালের বেলায় ওই উচ্চতা ১৬ হাজার মিটার। রাফালে দুটি স্নেকমা এম৮৮ ইঞ্জিন আছে। সেগুলোর প্রতিটি ৭৫ কিলোনিউটন পর্যন্ত থ্রাস্ট দিতে সক্ষম। অন্যদিকে জে-১০সি-তে থাকা একটিমাত্র ডব্লিউএস-১০বি তাইহাং ইঞ্জিনেরই থ্রাস্ট প্রায় ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোনিউটন। দুটি বিমানেরই সর্বোচ্চ গতি মাক ১ দশমিক ৮। তবে এই ক্ষেত্রে রাফাল আকাশযুদ্ধে কিছুটা এগিয়ে থাকতে পারে। জে-১০সি বিমানের একটি সুপরিচিত দুর্বলতা হলো এর যুদ্ধ পরিসর অল্প। অভ্যন্তরীণ জ্বালানি দিয়ে বিমানটি মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। আর তিনটি ট্যাঙ্কের জ্বালানি দিয়ে এক হাজার ২৪০ কিলোমিটার। অন্যদিকে তিনটি ট্যাঙ্কে জ্বালানি নিয়ে রাফালের যুদ্ধ পরিসর এক হাজার ৮৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
বহুমুখী বনাম বিশেষায়িত বিমান যুদ্ধ :
রাফালের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার কারণ এর নমনীয় বহুমুখী নকশা। ভূমিতে ও জাহাজে আক্রমণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতাকে এক করে এটি স্থল ঘাঁটি এবং বিমানবাহী রণতরী দুটি প্ল্যাটফর্ম থেকেই পরিচালনা করা সম্ভব করে তোলে। এর শক্তিশালী এসসিএএলপি-ইজি ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম স্টর্ম শ্যাডো। সহজে ধরা পড়ে না এবং দীর্ঘপাল্লার ওই ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ৫৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত নির্ভুলভাবে আঘাত করতে সক্ষম। রাফালে আরও আছে হ্যামার নামের খুবই ক্ষিপ্র মডুলার বড় পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। ভূমিতে আক্রমণ চালানোর এই স্ট্যান্ড-অব মারণাস্ত্রটি ৬০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে। গত ৭ মে তারিখের সংঘর্ষে পাকিস্তানের ভূমিতে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে এটি ছোড়া হয় বলে জানা যায়। চীনের মূল জে-১০ বিমান ১৯৯৮ সালে প্রথম আকাশে উড়ে। ২০০৩ সালে বিমানটি পরিষেবায় আসে। এটি ছিল চীনের প্রথম নিজস্ব নকশায় তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। যদিও এটি একটি বহুমুখী বিমান হিসেবে কাজ করতে পারে, তবে বহুমুখিতার ক্ষেত্রে এটি রাফালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো করে তৈরি করা হয়নি। আর জে-১০সি হল ওই সিরিজের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণ। এর ইঞ্জিন আরও উন্নত। এতে উন্নত এভিওনিক্স রয়েছে, যা চীনের পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ এর অনুরূপ বা কাছাকাছি বলে জানা গেছে। জে-১০সি চীনের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য বিমান যুদ্ধ এবং শত্রুপক্ষকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যে তৈরি। ফলে চীনা বিমান বাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধবিমানগুলো অন্যান্য কাজে লাগানো হয়। দেশটির সমন্বিত ডেটা নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করে, বিমানটির রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্র, বিশেষ করে বিভিআর ব্যবস্থার সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারে। এতে বিমানটির পাল্লা এবং অস্ত্র লোড করার ক্ষমতার ক্ষেত্রে এর ত্রুটিগুলো কমিয়ে আনা যায়।
২৯ থেকে ৩০ এপ্রিল রাতের মধ্যে কাশ্মীরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর মধ্যে আকাশে সংঘর্ষের সময় জে-১০সি বিমানের ওইসব ক্ষমতা কাজে লাগানো হতে পারে। ওই ঘটনায় পাকিস্তানি বিমান বাহিনী তার জে-১০সি দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর চারটি রাফালকে রুখে দেয়, যা কাশ্মীরকে ভাগ করা লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে টহল দিচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম দিয়ে রাফালের অন-বোর্ড সেন্সর এবং রাডার সিস্টেমগুলো আটকে দেওয়া হয় এবং ভারতীয় বিমানগুলোকে ‘পিছু হটতে বাধ্য করা হয়’।
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.