অতিমাত্রায় বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ পানাম নগর; বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা
সৈয়দ আবু মকসুদ
-
Update Time :
মঙ্গলবার, ১০ জুন, ২০২৫
-
৩৯
Time View

এক সময়ের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা বাংলার এই রাজধানীর জনপদ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গৌরবোজ্জ্বল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে ঈশা খাঁ এই অঞ্চলে গড়েছিলেন বাংলার প্রথম রাজধানী। সেই রাজধানীর ছায়াতেই বিকশিত হয়েছিল পানাম নগর, একসময়ের জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র, ধনী বণিকদের বসতি এবং নান্দনিক স্থাপত্যশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। প্রতিদিনই সন্ধ্যা নামে পানাম নগরে, কিন্তু সেই সন্ধ্যা আর উৎসবের নয়, যেন এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। যেখানে একদিন বণিকদের ময়ূরপঙ্খি নৌকা ভিড়ত ঘাটে, এখন সেখানে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। যে ঘরগুলোতে গানবাজনার জলসা বসত, সেখানে আজ শোনা যায় শুধু ঝরে পড়া পাতার শব্দ আর বাতাসের গুঞ্জন। তবে বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম ছিল এই সোনারগাঁ। ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পানাম নগরের সেই ভবনগুলো আজ অতিমাত্রায় বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি ভবনের জরাজীর্ণ দেয়ালের ফাটলে, ধসে পড়া কার্নিশে, ভেঙে যাওয়া জানালায় লুকিয়ে আছে এক হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের বিষণ্ন গল্প।
১৫ শতকে বাংলার স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এই অঞ্চলেই। এ অঞ্চলে মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা- দুই নদীপথে পালতোলা নৌকার যাতায়াত ছিল দৈনন্দিন দৃশ্য। এখানে বিলেত থেকে আসত বিলাতি থানকাপড়, আর এখানকার অতুলনীয় মসলিন ছড়িয়ে পড়ত দুনিয়াজুড়ে। এই নদীপথেই গড়ে উঠেছিল ব্যবসা, আর ব্যবসার হাত ধরেই বিকশিত হয়েছিল স্থাপত্য ও শহর। এই নগরীর গঠন ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় পানাম নগরী গড়ে ওঠে নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে। ইতিহাসবিদদের মতে, সোনারগাঁ নামটির উৎপত্তি ‘সুবর্ণ গ্রাম’ থেকে। ১৩ শতকে হিন্দু রাজা দনুজ মাধব দশরথদেব এই সুবর্ণ গ্রামকে তার শাসনকেন্দ্রে রূপ দেন। এরপর মুসলিম শাসনের সূচনায় সোনারগাঁ রূপ নেয় বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে। ঢাকা সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার এক গৌরবময় রাজধানী।
ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই নগরী আজও দর্শনার্থীদের বিস্ময়ে মোহিত করে রাখে। একসময় যেখানে পদচারণা ছিল ব্যবসায়ী, জমিদার আর বণিকদের, সেসব পথ আজ ধরে হেঁটে চলে ইতিহাসপ্রেমী মানুষ, পর্যটক আর গবেষকরা। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই নগরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটির দুই পাশে একসময় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ১০২টি অনবদ্য স্থাপনা-যেগুলো ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু বর্তমানে সেগুলোর অর্ধেকই বিলুপ্ত—খণ্ডিত সময়ের সাক্ষ্য হয়ে এখন কোনোভাবে টিকে আছে মাত্র ৫২টি ভবন। এই পুরাকীর্তিকে ২০০৩ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গেজেটভুক্ত করে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির মর্যাদা দেয়। ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ঐতিহাসিক পানাম নগরে প্রবেশ করতে হলে পর্যটকদের টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় করেন পানাম নগরের সরু পথে। প্রবেশপথে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা সতর্ক করলেও অনেকেই রোমাঞ্চ আর কৌতূহলে প্রবেশ করে বিপজ্জনক ভবনগুলোর ভেতরে। বাড়তি নিরাপত্তা না নিলে এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই বলে মনে করেন স্থানীয়রা। বর্তমানে পানাম নগরে প্রতিদিন শত শত মানুষ ইতিহাসের এই জীবন্ত ক্যানভাস দেখতে আসেন।
Please Share This Post in Your Social Media
More News Of This Category
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.