ওমানের বিপক্ষে ড্রয়ের মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে ফিলিস্তিনের বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বপ্নযাত্রা। মাঠের লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির সময় গাজায় মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে ক্রীড়াঙ্গনের ভবিষ্যৎ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডের ক্রীড়াপ্রেমীদের মতে, তারা আবার মাঠে ফিরতে পারলেও তাতে লাগবে অন্তত এক দশক।
খান ইউনুসে নিজের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরের ভেতর ৭৫ বছর বয়সী শাকের সাফি হাত বুলিয়ে দেখছিলেন তার ছেলে মোহাম্মদের পুরনো ছবি। মোহাম্মদের হাতে গড়া জুনিয়র ফুটবল দলের ট্রফি, মেডেল, দলের হাডল করা মুহূর্তের ছবি—সব এখন স্মৃতিচিহ্ন, এক অসমাপ্ত স্বপ্নের নীরব সাক্ষী। ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর, ইসরায়েলি এক বিমান হামলায় নিহত হন মোহাম্মদ সাফি—একজন ফুটবল কোচ এবং শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক। গাজার স্কুল ও স্থানীয় ক্লাবে বছরের পর বছর ধরে কিশোর ফুটবলারদের গড়ে তুলেছিলেন তিনি। আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক মোহাম্মদ ছিলেন দক্ষিণ গাজার আল-আমাল ফুটবল ক্লাবের প্রধান কোচ। ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী খেলোয়াড়দের মাঝে তার সুনাম ছিল অপরিসীম। শাকের বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনকে প্রতিনিধিত্ব করার। সে বিশ্বাস করত—খেলা তরুণদের হতাশা থেকে বের করে আনতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ তার আগেই থামিয়ে দিল তাকে। মোহাম্মদের স্ত্রী নীরমীন ও তাদের চার সন্তান—শাকের জুনিয়র (১৬), আমির (১৪), আলমা (১১) ও তাইফ (৭)—আজ শূন্যতা আর কষ্ট নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কাছে বাবার শেষ ফুটবল, কোচিংয়ের নোটবইই এখন একমাত্র সম্বল। ছোট্ট তাইফ যখন জিজ্ঞাসা করে, আমাদের কাছ থেকে বাবাকে কেন কেড়ে নিল ওরা? তখন মায়ের চোখে জল ঝরে। সে রাজনীতিবিদ ছিল না, স্বপ্নবাজ ছিল, বলেন নীরমীন। আন্তর্জাতিক রেফারি হতে চেয়েছিল, মাস্টার্স করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে মেরে ফেলা হলো, কারণ সে ছিল জীবনের প্রতীক।
গাজায় যারা এখনও বেঁচে আছে, তাদের কাছে খেলাধুলা এখন বিলাসিতা। বেঁচে থাকাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। ২০ বছর বয়সী ইউসুফ আবু শাওয়ারিব, রাফাহর প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের গোলরক্ষক। মে ২০২৪-এ নিজের ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেন খান ইউনুস স্টেডিয়ামে—যেখানে একসময় খেলতেন ম্যাচ। আজ সে মাঠে নেই ফুটবলারের ছায়া, বরং সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শরণার্থীদের তাঁবু।এই জায়গায় আমার কোচ আমাকে ম্যাচের আগে ব্রিফ করতেন। এখন আমি এখানে পানির জন্য অপেক্ষা করি, কিক অফের জন্য নয়, বলেন ইউসুফ। আজ তার রুটিন কেবল মাঝেমধ্যে নিজের তাঁবুতে হালকা অনুশীলন। জার্মানিতে খেলার স্বপ্ন কিংবা খেলাধুলা নিয়ে উচ্চশিক্ষার চিন্তা—সব এখন অতীত।
ধ্বংসের মাঝেও কিছু আশা টিকে আছে। ফিলিস্তিনের অ্যাম্পিউটি ফুটবল দলের প্রধান কোচ শাদি আবু আরমানা যুদ্ধের আগে ছয় মাসব্যাপী একটি প্রস্তুতিমূলক পরিকল্পনা করেছিলেন। তার ২৫ জন খেলোয়াড় ও পাঁচ সদস্যের কোচিং স্টাফ নিয়ে দলটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিল। ২০১৯ সালে তারা ফ্রান্সে অংশ নিয়েছিল, আবার ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ২০২৫ সালের অক্টোবরের জন্য পরিকল্পনা ছিল। এখন তো একসঙ্গে জড়ো হওয়াটাই সম্ভব না, বলেন শাদি। সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে—হোম, মাঠ, গিয়ার, কিছুই নেই। খেলোয়াড়দের অনেকেই পরিবারের সদস্য হারিয়েছে, কেউ কেউ নিজের বাড়িও। তিনি বলেন, যুদ্ধ থেমে গেলেও, আমরা যা হারিয়েছি তা ফিরিয়ে আনতে বছর লাগবে। এটা শুধু থেমে যাওয়া নয়, এটা একেবারে ‘মুছে ফেলা’।
ফিলিস্তিন অলিম্পিক কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট আসআদ আল-মাজদালাওয়ি বলেন, গাজার ক্রীড়াব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথে। কমপক্ষে ২৭০টি ক্রীড়া স্থাপনা আঘাতপ্রাপ্ত, যার মধ্যে ১৮৯টি সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং ৮১টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। গাজার ক্রীড়া অবকাঠামোর প্রতিটি স্তরে হামলা হয়েছে—অলিম্পিক অফিস, ক্রীড়া ফেডারেশন, ক্লাব, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া কার্যক্রম—সবকিছু, বলেন আল-মাজদালাওয়ি। নিহতদের তালিকায় রয়েছেন আন্তর্জাতিক কারাতে চ্যাম্পিয়ন নাঘাম আবু সামরা, ১৯৯৬ সালের অলিম্পিকে পতাকা বহনকারী মাজেদ আবু মারাহিল, জাতীয় ফুটবল কোচ হানি আল-মাসদার এবং অ্যাথলেটিকস কোচ বিলাল আবু সামান। এটা শুধু ক্ষতি নয়, এটা এক ধরনের নির্মূল প্রক্রিয়া, বলেন আল-মাজদালাওয়ি। প্রতিটি খেলোয়াড় ছিল একেকটি কমিউনিটির স্তম্ভ। তারা সংখ্যা নয়, তারা প্রতীক ছিল—আশা, ঐক্য ও সংগ্রামের প্রতীক।
আল-মাজদালাওয়ির মতে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংগঠনগুলো শুধু নীরবই নয়, বরং একপ্রকার দায় এড়িয়ে চলেছে। তিনি বলেন, প্রাইভেটভাবে অনেকে সমবেদনা প্রকাশ করে, কিন্তু সিদ্ধান্তের স্তরে এসে ইসরায়েল যেন আইনের ঊর্ধ্বে। খেলাধুলার নিয়ম বা মানবাধিকার—সবই এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা ১৯৯৪ সাল থেকে এই ক্রীড়া কাঠামো গড়ে তুলেছি। জ্ঞানের স্তর, পেশাদারি, অবকাঠামো—সব ছিল। এখন তা কয়েক মাসেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুদ্ধ এখনও চলছে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তবুও শাকের সাফি, ইউসুফ, শাদি—তারা সবাই বিশ্বাস করেন, একদিন খেলাধুলা আবার হয়ে উঠবে তাদের অস্তিত্ব, আশা আর জীবনের পরিচয়। এখন তো শুধু কামনা করি, আগামীকাল যেন খাওয়ার কিছু পাই, বলেন ইউসুফ। যুদ্ধ শুধু মাঠ ভাঙেনি, আমাদের ভবিষ্যৎও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তিনি যখন পোড়া স্টেডিয়ামের দিকে তাকান, তখন তা শুধুই সাময়িক আশ্রয় নয়—একটা জাতিগত ‘মুছে ফেলার’ প্রতীক।
মূল: আল জাজিরা।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.