স্মরণীয় অভিনেতা শওকত আকবর,স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শওকত আকবর বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে আড়াইশ’ ছবিতে অভিনয় করেন। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তিনি সুমিতা দেবী, রোজী, শর্মিলী, রেশমা প্রমুখের বিপরীতেই বেশি ছিলেন। লাহোরে গিয়ে তিনি সোফিয়া রানু, রোজিনা, রুখসানা, শামীম আরা, বাহার প্রমুখ নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। সেই শওকত আকবর ১৯৯৬ সালে এক অর্থে অভিমান করেই দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। শেষদিকে তাকে ঢাকার ফিল্মের প্রযোজক-পরিচালকরা ঠিকভাবে কাজে লাগাননি। লন্ডনে গিয়েও তিনি অভিনয় ছেড়ে দেননি একদম। বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকও পরিচালনা করেন। ২০০০ সালের ২৩ জুন শওকত আকবর লন্ডনে মারা যান। লন্ডনেই মুসলিম কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
রহমান, আজিম, নাদিম যখন শীর্ষে তখন শওকত আকবরও ছিলেন খ্যাতির তুঙ্গে। এইতো জীবন, আলোর পিপাসা, অভিশাপ, মিলন, সাগর, পুণম কি রাত, ওয়েটিংরুম, জংলী ফুল, অবুঝ মন, মোমের আলো, দিল এক মিশা প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করে তিনিও স্মরণীয় হয়ে থাকলেন। আর এ জন্যই তো তিনি কিংবদন্তি।
শওকত আকবরের আসল নাম সাঈদ আকবর হোসেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালে পশ্চিম বাংলার বর্ধমান শহরে। স্কুলজীবনে বেশ কয়েকটি বছর তিনি হুগলি স্কুলে পড়াশোনা করেন। শওকত আকবরের পিতা ছিলেন হুগলির ইসলামিক কলেজের প্রভাষক। স্কুলজীবন থেকেই শওকত আকবরের নেশা হয়ে দাঁড়াল সিনেমা দেখা। প্রমথেশ বড়ুয়া, অমিত বরণ, রবীন মজুমদারের ছবি দেখার জন্য প্রায়ই যেতেন কলকাতায়। ছবি দেখে দেখে তার মনেও ইচ্ছা জাগে একজন অভিনেতা হওয়ার। স্কুলজীবনে তিনি স্টেজে অভিনয় শুরু করে দেন। প্রথম ‘দেবদাস’ নাটকে অভিনয় করেন। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১৫ বছর। সে সময় শওকত আকবর হুগলিতে ছিলেন। ১৯৫০ সালে বর্ধমান জেলায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তত্কালীন পূর্ববাংলার ঢাকায় চলে এলেন।
কিন্তু কী আশ্চর্য যার ডাক্তার হওয়ার কথা, চিকিৎসকের মত মহৎ পেশা ও দায়িত্বের প্রতি যিনি আকৃষ্ট হবেন—তিনি অবশেষে হলেন রুপালি পর্দার অভিনেতা।
শওকত আকবর প্রথম ‘এইতো জীবন’-এ অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এইতো জীবন ছবিটি রিলিজের আগেই ১৯৬৩ সালে তার অভিনীত—‘তালাশ’ এবং ‘পয়েসে’ ছবি দুটি মুক্তি পায়। এরপর একে একে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো—আগুন নিয়ে খেলা, ভাইয়া, আখেরি স্টেশন, জংলী ফুল, ওয়েটিংরুম, দিল এক শিশা, বেরহম, হামদাম, অপরিচিতা, অভিশাপ, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, শরীফে হায়াত, সাতরং, গৌরী, জীবন থেকে নেয়া, বড় বৌ, টাকা আনা পাই, মোমের আলো, চলো মান গায়ে, আলোর পিপাসা, নতুন সুর, মেঘ ভাঙা রোদ, জানাজানি, আপন দুলাল, ইশারা, অবুঝ মন, ফকির মজনু শাহ প্রভৃতি। ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে শওকত আকবর ভবানী ঠাকুরের চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন।
শওকত আকবরের চেহারা নায়কসুলভ থাকা সত্ত্বেও ঢাকার চিত্র পরিচালকরা তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেননি। তিনি হাতেগোনা কয়েকটি ছবির নায়ক ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে। সেসব ছবি হলো—দিল এক শিশা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, পুণম কী রাত, জুগনু, আওর গম নেহি, এইতো জীবন প্রভৃতি। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকাকালীন তার সঙ্গে ১৯ ৯৬সালে দেখা হওয়ার স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, আমি অভিনয়কে বেশি গুরুত্ব দিই বলে নায়ক রোলের চেয়ে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বরাবর পছন্দ করেছি, অর্থাত্ যে ছবিতে অভিনয় করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আর এ ধরনের ছবিতেই বেশি অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি।
শওকত আকবর মঞ্চে নাটক করাকালীন তার সঙ্গে মঞ্চ অভিনেত্রী মুক্তার সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর দু’জনার মধ্যে মন দেয়া-নেয়া হলো। অবশেষে ১৯৬১ সালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালে তাদের প্রথম ছেলে ভূমিষ্ঠ হলো। সেই ছেলের নাম মিল্টন আকবর, তিনি এক সময় লন্ডনের নামকরা ড্রামবাদক ছিলেন। ঢাকার চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে শওকত আকবর লন্ডনে ছেলের ওখানে ১৯৯৬ সালে চলে গিয়েছিলেন। অভিনয়ের প্রথমদিকে তার অভিনীত উর্দু ছবি ‘তালাশ’, ‘আখেরি স্টেশন’ এবং ‘ভাইয়া’ তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে রিলিজ হওয়ার কারণে লাহোর, করাচী, মুলতান, পেশোয়ার, মারী, গুজরানওয়ালা, কোয়েটা, শিয়ালকোট, ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি, গিলগিট প্রভৃতি শহরেও তার নাম সিনেমা প্রেমিকদের মুখে মুখে ছিল, যা কিনা আজ সবাই ভুলতে বসেছে।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.