সৈয়দ আবু মকসুদ, চট্টগ্রাম :
চট্টগ্রামে ৩৪ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৮ হাজার জলাধার। দিন দিন জলাধার ভরাট হয়ে যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার সংরক্ষনে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই দায়ী। ফলে একদিকে যেমন ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস হারিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাশয় ভরাট প্রতিরোধে আইন থাকলেও তার তোয়াক্কা করেন না কেউ। প্রশাসনও এসব আইন প্রয়োগে আন্তরিক নন বলেও অভিযোগ পরিবেশ কর্মীদের।
১৯৯১ সালের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ২৫০। ২০০৬-০৭ সালে আরেকটি জরিপ চালান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ জরিপে দেখা যায় নগরীতে জলাশয়ের পরিমাণ মাত্র ৪ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে কি পরিমালণ জলাশয় আছে এর কোনো সঠিক চিত্র সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগের কাছেই নেই।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে চট্টগ্রামে এক হাজারেরও কম জলাশয় বিদ্যমান রয়েছে। তবে ১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলামের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে তখন জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪১। দশবছর পর ১৯৯১ সালে আরেকটি জরিপ চালান তিনি। ওই জরিপ অনুযায়ী দশবছরে প্রায় ১৩ হাজার জলাশয় হারিয়ে যায় বলে দাবি করেন তিনি।
পরিবেশবাদি সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান এস এম টিভিকে বলেন,‘অনেকগুলো জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এভাবে যদি আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করে তাহলে কিছুদিন পর চট্টগ্রামে জলাধার খুঁজে পাওয়া যাবে না। যা পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাড়াবে। ’
সরেজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের পরিচিত অধিকাংশ জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। এক শ্রেণীর ভূমিদস্যুরাও নগরী ও গ্রামের অবশিষ্ট পুকুর ও জলাশয় ভরাটে তৎপর রয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণা পত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে চট্টগ্রামে এক সময় যেসব দিঘী ছিল- দেওয়ান গৌরী শংকর দীঘি, লালদীঘি, হামজার দীঘি, টেক চাঁদের দীঘি, আমীর খাঁর দীঘি, শিব খাঁর দীঘি, হাজারীর দীঘি, এতিম শাহের দীঘি, খঞ্জর দীঘি, রানীর দীঘি, নুনু খাঁর দীঘি, শিব লালের দীঘি, মাজাবির দীঘি, মৌলভী পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, ভেলুয়ার দীঘি, জোড়া দীঘি এবং কমলদহ দীঘি। এর মধ্যে ভরাট হয়ে গেছে আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ান বাজারের দেওয়ানজি পুকুর, নন্দনকানন রথের পুকুর, চান্দগাঁও মৌলভী পুকুর, ফিরিঙ্গি বাজার ধাম্ম পুকুর, বহদ্দারহাট এলাকার মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দীঘি, কাট্টলী সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দীঘি। ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে চান্দগাঁওয়ের মুন্সিপুকুর, আশকার দীঘি, আগ্রাবাদ ঢেবার দীঘিসহ নগরীর অসংখ্য পুকুর ও দীঘি। আশকারদীঘি ও ঢেবার দিঘীর অভ্যন্তরে ক্রমান্বয়ে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বস্তি।
১৯৩৯ সালের পুকুর উন্নয়ন আইন অনুযায়ী, বেসরকারি মালিকানাধীন পতিত হিসেবে চিহ্নিত কোনো দিঘি বা পুকুরের প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক কাজ করে তা মাছ চাষের আওতায় আনার জন্য জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুকুর মালিককে নোটিশ দেবেন। নোটিশ দেওয়ার পর যদি পুকুর মালিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাছচাষ না করেন, তাহলে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট পুকুরটিকে একটি পতিত পুকুর হিসেবে ঘোষণা করে ওটা অধিগ্রহণ করবেন। কিন্তু পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকা আসকার দিঘী, বলুয়ার দিঘী কিংবা অন্য কোনো জলাশয়ের ক্ষেত্রে এখনো এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া কোন জলাশয় বা পুকুর ভরাটের আগে ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বিষয়ে জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এ উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তাও কেউ মানছেন না। আইন প্রয়োগেও তৎপর নয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরিবেশ অধিদপ্তরও নিয়মিত পানি পরীক্ষা করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আল আমীন এস এম টিভিকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে পুকুর, দীঘি ও জলাশয়ের দুই-তৃতীয়াংশই ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ক্ষমতাশালী ভূমিদস্যু ও স্বার্থান্বেষী মহল এর সঙ্গে জড়িত। জলাশয় ভরাটের কারণে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ’
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান শেখ বলেন, ‘নগরীতে পানির উৎস কমে যাওয়ার কারণে আগুন নেভানোর কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বাড়ছে। পুকুর ভরাটের আগে অনাপত্তিপত্র কেউ নেন না। আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে আমরা তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। এখন যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেয় আমাদের কি করার আছে। আমাদের তো আর ফোর্স নেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো। ’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. শহীদুল আলম এস এম টিভিকে বলেন, ‘জলাধার ভরাটের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’ তবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে কাজ কিছুটা ব্যহত হয় বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
© All rights reserved © 2025 Coder Boss
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.