কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী নূরজাহান উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান শিল্পী,সুরকার,অভিনেত্রী এবং চলচ্চিত্র পরিচালক। এছাড়াও নুরজাহান এর সম্মানিত খেতাব মালিকা-ই-তারান্নুম নামে পরিচিত সুরের রানী হিসেবে ছিলেন একজন পাকিস্তানি গায়িকা এবং অভিনেত্রী।
নুর জাহান জীবনের প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ ভারতের হয়ে অভিনয় জীবন এবং খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দেশভাগ হওয়ার পরবর্তীতে পাকিস্তানের হয়ে একজন নিবেদিত প্রাণ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
নায়িকা হিসেবে বলিউড চলচ্চিত্র জগতে নুরজাহান যেসব সিনেমায় অভিনয় করেন,তার উল্লেখ্যযোগ্য হলো ১৯৩৫ শীলা,গুল বাকাওলি,ইমানদার,
পিয়াম-ই-হক,সজনি,যমলা জাত,চৌধুরী,রেড সিগনাল। উমরিদ,সাসরাল।
এছাড়া নুরজাহানের চন্দনি,ধীরাজ,ফরিয়াদ খান্দান – ১৯৪২ সালের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।
নাদান,দুহাই, নকার – ১৯৪৩ সালে সর্বোচ্চ ব্যাবসা সফল ভারতীয় চলচ্চিত্র লাল হাবেলী,১৯৪৪ সালে দোস্ত,সব গুলো চলচ্চিত্রে তিনিই ছিলেন হিরোইন।
কণ্ঠশিল্পী নুরজাহান প্রায় ৬ দশকের অধিক সময় ধরে তার কর্মজীবনের পার করেন। তিনি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন।
যার স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি পাকিস্তানের অন্যতম সম্মানসূচক মালিকা-ই-তারান্নুম বা সুরের রানী খেতাব লাভ করেছিলেন। তিনি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি সংগীতের অন্যান্য ধারার প্রতিও দূরদর্শী ছিলেন।
কণ্ঠশিল্পী নুরজাহান ভারতীয় সঙ্গীত অনুরাগী একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং পিতা মাতার বাদ্যযন্ত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি শৈশবকাল থেকেই একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন।
যদিও নুরজাহান বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অতি সহসাই দর্শক প্রিয়তা পেয়ে বলিউড চলচ্চিত্র জগতে সাড়া ফেলেছিলেন। কিন্তু গান যেহেতু তার হৃদয় তন্ত্রীতে অবিচ্ছেদ্য ভাবে গাথা তাই একসময় অভিনয় ছেড়ে গানকেই কন্ঠে তুলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুরের মুর্ছনায় জড়িয়ে ছিলেন।
নুর জাহান ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষায় প্রায় ১৮ হাজার এর উপরে গান রেকর্ড করেছেন, যার মধ্যে যেমন:- উর্দু,পাঞ্জাবী,পশতু,সিন্ধী এবং ফার্সি ভাষাও রয়েছে। সঙ্গীতশিল্পী আহমেদ রুশদির সাথে দ্বৈতকণ্ঠ দিয়ে তিনি পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক চলচ্চিত্রের গানের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করার কীর্তি গড়েন।
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গানের ভুবনে সুরের ইন্দ্রধনু তুলে ধরার জন্য নুরজাহানকে সর্বকালের সেরা একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে মনে করা হয়।
এছাড়াও নুরজাহান একজন মহিলা পরিচালক হয়ে পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা করার জন্য তাকে প্রথম মহিলা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান নূর জাহানকে অভিনয় এবং সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরুপ পাকিস্তানের অন্যতম সম্মানীয় পুরস্কার “প্রাইড অব পারফরমেন্স” প্রদান করেন।
বিশেষ করে নুরজাহান ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কার সবচে বেশী দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার জন্য। এছাড়াও তিনি পাকিস্তানি সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার তামা-ই-ইমতিয়াজ এবং সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পুরষ্কার জিতে নেন।
নূর জাহান পাকিস্তানে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন একে একে ২ বার। এরমধ্যে ১৯৮৭ সালে একবার এবং ২০০২ সালে মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আরো একবার পান।
নূর জাহান ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের কাসুরের একটি পাঞ্জাবী মুসলিম পরিবারে ২১ শে সেপ্টেম্বর ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমদাদ আলী এবং ফতেহ বিবি দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। এগারো ভাই বোনের মধ্যে নুরজাহান অন্যতম একজন হিসেবে শিল্পী হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করেন।
নূর জাহান ১৯৪২ সালে শওকত হোসেন রিজভীকে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৫৩ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এই দম্পতির ঘরে তিন সন্তানের জন্ম হয়,যেখানে জিল-ই-হুমা নামে একজন কন্যা সন্তান সঙ্গীতশিল্পী হন।
এছাড়া ১৯৫৯ সালে শিল্পী নুরজাহান পুনরায় এজাজ দারানিকে বিবাহ করেন। এই দম্পতির ঘরেও তিন সন্তানের জন্ম হয় কিন্তু পরিশেষে আগের মতই ১৯৭০ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।
২০০০ সালের ২৩শে ডিসেম্বর কণ্ঠশিল্পী নুরজাহান মৃত্যু বরণ করেন।